সমসাময়িক বিবর্তন: টিকটিকি

সমসাময়িক বিবর্তন: টিকটিকি

কবিগুরু একদিন বড় আক্ষেপ করে বলেছিলেন,

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া, 

একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু।

কিছুটা কবিগুরুর আক্ষেপ আমাদের বিজ্ঞানচর্চার জগতেও হরহামেশাই দেখা যায়। কয়দিন আগে একটা ভিডিও ভাইরাল হলো, যেখানে চিনির পাত্রে লবঙ্গ রাখার ফলে পিঁপড়ারা চিনি চুরি করতে পারছিলোনা। এজন্য তারা একটা দুর্দান্ত বুদ্ধি করে, তারা ক্রমশ চেষ্টা করে করে সেই লবঙ্গকে চিনির নিচে ঢেকে দেয় যেনো লবঙ্গের ঘ্রাণ তাদের চুরিকে আর বাঁধাগ্রস্ত করতে না পারে। একবার নয়, বারবার এটা করছিলো ওই পিঁপড়াগুলো। এখন এটা মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের এক বিশাল বড় উদাহরণ যেখানে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হয় টিকে থাকার জন্য। কিন্তু বাংলা বলে ওই ভিডিওটা শুধু একটা ভাইরাল ভিডিও হয়ে রয়ে গিয়েছে, গবেষণা পর্যায় পর্যন্ত পৌছায়নি। যাহোক, এমন এক অভিযোজন নিয়েই কথা বলব আজ যেটা আমাদের চারপাশেই ঘটছে কিন্তু আমরা খেয়াল করছিনা। আগে একটু মূলতত্ত্ব আলোচনা করা যাক। বিবর্তনের প্রধান কারিগরদের একটি হলো প্রাকৃতিক নির্বাচন- যার মাধ্যমে কোনো এক প্রাণীর কিংবা গোষ্ঠীর সামগ্রিক অভিযোজন ঘটতে পারে। শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য নয় কখনো কখনো নিজের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য কিংবা আরও অধিক সুন্দর জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক কিংবা সামাজিক যে পরিবর্তন সেটারই পুঁথিগত নাম দিয়েছি আমরা “অভিযোজন”। এরকম অভিযোজন নানান ভাবে, নানান উপায়ে, নানান কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অভিযোজনের উদ্দেশ্য যখন নিজের টিকে থাকা, নিজের জীবনযাপন উন্নত করা, নিজের আধিপত্য বিস্তার করা তখন যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা ঘটে সেটাকে আমরা বলি “প্রাকৃতিক নির্বাচন”। যদি এই অভিযোজনের উদ্দেশ্য হয় বংশবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ কিংবা যৌনসঙ্গী প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় নিজেকে শীর্ষে রাখা তবে তখন সেটা “যৌনতার নির্বাচন”। তিকতালিক এসব নিয়ে বিস্তর আলাপ আগেও করেছে, করছে, ভবিষ্যতে আরও বহু ইতিহাস, নীতি, নিয়মকানুন আপনাদের জানাবে। তবে আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য একটু আলাদা। আজকে আমাদের আলোচনাটা মানবঘটিত প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে, আজকের আলোচনাটা অত্যন্ত দ্রুত হারে হওয়া বিবর্তন নিয়ে, আজকের গল্পটা শহুরে টিকটিকি নিয়ে।

শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকায় যেখানে কংক্রিটের দেয়াল, উত্তপ্ত পিচ আর অ্যাসফল্টের রাস্তা প্রাধান্য পায়, সেখানে টিকে থাকতে মানুষকেই বহুভাবে অভিযোজিত হতে হয়। তবে এই অভিযোজন শারীরিক কম, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিকভাবে বেশি হয়ে থাকে। এই কনক্রিটের শহরে টিকতে গিয়ে প্রকৃতির অন্যতম এক ক্ষিপ্র বাসিন্দার মধ্যে সূক্ষ্ম কিন্তু লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটছে। এই চতুর সরীসৃপগুলো শহুরে কোলাহলের মাঝে প্রায়শই চোখের আড়ালে, মানবসৃষ্ট পরিবেশের সাথে উল্লেখযোগ্য উপায়ে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় অবিযোজন টিকটিকির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপেক্ষাকৃত অধিক লম্বা হওয়া। গাছে, বন্য পরিবেশে কিংবা অন্য প্রাকৃতিক আবাসস্থলে বসবাসকারী আত্মীয়দের তুলনায় শহুরে টিকটিকির এই শারীরিক গঠন যথেষ্ট ভিন্ন ও নতুন। এই অভিযোজন দেখা গেছে আমেরিকার স্থানীয় সরিসৃপ অ্যানোলসদের মধ্যে (৪২৫ প্রজাতির টিকটিকি এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত), ফেন্স লিজার্ডদের মধ্যে (এরা সাধারণত জঙ্গল এবং শহরের সীমানায় গাছে বসবাস করে), ওয়াল লিজার্ডদের মধ্যে (এরা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, দেয়ালে দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়)। নগরায়ন দ্বারা প্রভাবিত দ্রুতগতির বিবর্তনের বা পরিবর্তনের প্রাণবন্ত উদাহরণ এই ঘটনা।

বনাঞ্চলের মতো প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলিতে টিকটিকিগুলি যে ত্রিমাত্রিক ভূখন্ডে চলাচল করে সেখানে বিশাল বিশাল বৃক্ষ, প্রচুর লতানো গুল্ম এবং অসম এবড়োথেবড়ো পৃষ্ঠ থাকে। এই পরিস্থিতিতে সহজে টিকে থাকার জন্য ছোট ছোট পা, শরীর এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকাটাই বেশি উপকারী। ডাল বেয়ে ওঠার সময়, ঘন গাছপালার মধ্য দিয়ে দ্রুত চলাচলের জন্য একপ্রকার স্থিতিশীলতা করে। গাছের পৃষ্ঠ একদিকে যেমন খাড়া-সোজা উলম্ব বরাবর, তেমনই খসখসে। এই উলম্ব তলে ওঠার সময় পৃথিবীর অভিকর্ষজ বল যে ভোগান্তি সৃষ্টি করে তা আরও বেড়ে যাবে যদি টিকটিকির দেহ বড় এবং ভারী হয়। আবার ঘন ডালপালার মধ্য দিয়ে সহজে নিজের শরীর গলিয়ে নিতে পারে ছোট অবয়বের সরীসৃপেরা, বড় শরীর, বেশি ভার নিয়ে এরা ডালপালায় আটকেই সহজে অন্যের শিকারে পরিণত হতো- পালানোর পথও পেতো না অন্যদিকে, শহুরে পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন করায় টিকটিকিদের। রাস্তাঘাট, ফুটপাত এবং বিল্ডিংয়ের দেয়াল দ্বারা প্রভাবিত এই পরিবেশে, উল্লম্ব কাঠামোর সংখ্যা একদিকে কম অন্যদিকে অনুভূমিক স্থানগুলো (মেঝে, ছাদ, ফুটপাত, উঠান সবকিছুই) অধিক প্রসারিত। এই কাঠামোগুলো মোটেও গাছের পৃষ্ঠের মতো খসখসে নয় কিংবা ঘন ডালপালা-লতাপাতা আবৃত নয় যে বড় শরীর হলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে, অন্যের শিকারে পরিণত হতে হবে। ফলে গাছে গাছে উলম্ব তলে চলাফেরায় দক্ষ এই টিকটিকিদের সমতল ভূখণ্ডে দ্রুত চলার দক্ষতা টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে।  

লম্বা দীর্ঘতর শরীর, পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বায়োমেকানিক্যাল দিক থেকে এই শহুরে পরিস্থিতিতে একটা সুবিধা প্রদান করতে পারপ। সেটি হলো এক এক পদক্ষেপে অধিক দুরত্ব অতিক্রম করা। এখানে ঘন লতাপাতার ভিতর দিয়ে যাওয়া লাগেনা, ডালপালায় শরীর আটকে যায়না, উলম্ব তলে নিজের ভরের কারণে উঠতে কষ্ট হয়না। শুধু দৌড়াতে হবে টিকতে হলে। যে যত দ্রুত দৌড়াতে পারবে, প্রতি পদক্ষেপে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে সে তত সহজে নিজের মৃত্যুকে জয় করে টিকে থাকতে পারবে। আর এটা করতেই সহায়তা করে লম্বা পা, দীর্ঘ কায়া।

শহুরে টিকটিকিরা দীর্ঘতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে আশেপাশের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে- এটা কোনো নিছক পর্যবেক্ষণ বা অনুমান না। বেশ কিছু গবেষণার মাধ্যমে এই হাইপোথিসিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটু বিস্তারিত দেখা যাক।

  • পুয়ের্তো রিকোতে অ্যানোল টিকটিকি নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের টিকটিকিদের পিছনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লম্বা। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তারা সমতল পৃষ্ঠে দ্রুত দৌড়ায়, যখন জঙ্গলের টিকটিকিরা সরু ডালে ভালো করে। ক্যালিফোর্নিয়ার ফেন্স টিকটিকি ও ইউরোপের দেয়াল টিকটিকিতেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে। একই পরিবেশে বড় করা হলে শহরের টিকটিকিদের লম্বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে যায়, যা জিনগত পরিবর্তনের প্রমাণ দেয়। যারা লম্বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মায়, তারা বেশি বাঁচে ও প্রজনন করে। এই গবেষণার ফলাফল Evolution জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। 
  • অনুরূপ প্রবণতা ক্যালিফোর্নিয়ার ফেন্স লিজার্ড এবং ইউরোপের ওয়াল লিজার্ডের মধ্যেও দেখা গেছে। ফেন্স লিজার্ডদের দৌড়ানো প্রথমে ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছে, পরবর্তীতে এই রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তাদের দৌড়ানোর গতি অধিক ক্ষিপ্র। এদের শহুরে লিজার্ডগুলোর পিছনের অঙ্গ গ্রাম্যগুলোর তুলনায় বেশি লম্বা যা আমাদের পূর্ববর্তী হাইপোথিসিস সমর্থন করে। একইভাবে, ইউরোপের শহরগুলোতে ঘুরে বেড়ানো ওয়াল লিজার্ডদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও এদের বন্য আত্মীয়দের তুলনায় দীর্ঘতর, লম্বা। এ থেকে বোঝা যায়, শারীরিক এই অভিযোজন কোনো একটা টিকটিকি কিংবা এক এলাকার টিকটিকি কিংবা এক প্রজাতির টিকটিকিতে ঘটছে না। ঘটছে সম্পূর্ণ আলাদা গণ, সম্পূর্ণ আলাদা শ্রেণীর মধ্যে। সাদৃশ্য শুধু কেনো ঘটছে সে প্রশ্নের উত্তরে।
  • এই যে টিকটিকির অভিযোজন, এটা কি স্থায়ী? নাকি আশেপাশের পরিবেশের প্রভাবে ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন মাত্র? স্থায়ী হলে এই পরিবর্তনকে আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচন বলতে পারব। ক্ষণস্থায়ী হলে এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচন নয় বরং এটাকে বলে “ডেভেলপমেন্টাল প্লাস্টিসিটি”। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা “common garden experiment” নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এই পরীক্ষা কিন্তু একবার নয়, বহুবার করা হয়েছে। এই পরীক্ষার লক্ষ্য ছিলো টিকটিকির শারীরিক পরিবর্তন জিনগত কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া। এই গবেষণায় শহুরে এবং বন্য টিকটিকিদের হুবহু একই পরিবেশে রাখা হয় যেন কোনোপ্রকার পারিপার্শ্বিক প্রভাব এদের আকার এবখ শারীরিক গঠনের উপরে না পড়ে। সবগুলো পর্যবেক্ষণের শেষে একই ফলাফল পাওয়া গেছে। শহুরে টিকটিকির সদ্যোজাত শিশু সন্তানদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং শরীর, বন্য টিকটিকির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপেক্ষা অধিকতর লম্বাই হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই যে শহুরে পরিবেশের টিকে থাকার জন্য শারীরিক পরিবর্তন তা মোটেও ক্ষণস্থায়ী কিংবা পরিবেশের সাময়িক প্রভাব না। বরং এই বৈশিষ্ট্য জিনগত এবং পিতা মাতা হতে সন্তানে প্রবাহিত হচ্ছে। তাই এটাকে ডেভেলপমেন্টাল প্লাস্টিসিটি না বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন তথা অভিযোজন হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে উভয় পরিবেশের টিকটিকিদের জিনোম তুলনা করা শুরু হয়েছে যেনো কোন কোন জিন এই পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তা নির্ধারণ করা যায়।

আজকের গল্পে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- বিবর্তনীয় পরিবর্তনের গতি। শহরায়ন প্রায়ই কয়েক দশকের মধ্যে ঘটে, যা বিবর্তনের দৃষ্টিকোণে সময়স্কেলে চোখের পলকের থেকেও কম সময়, তবুও এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শারীরিক পার্থক্য দেখা দিয়েছে উক্ত সরীসৃপদের মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ- পুয়ের্তো রিকোর শহরাঞ্চলে থাকা অ্যানোল জনগোষ্ঠী যারা ১৯ শতকে এই দ্বীপে প্রবর্তিত হয়েছিলো, শহরের সংস্পর্শে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য দেখিয়েছে। এই দ্রুত অভিযোজন শক্তিশালী সিলেকশন প্রেশারের ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের সমসাময়িক বিবর্তনের গল্পগুলোই উদাহরণ যে বিবর্তন চলমান। আপনি, আমি আমাদের অজান্তেই এই বিবর্তনে সরাসরি অংশ নিয়ে চলেছি। মানুষের ক্রিয়াকলাপ শক্তিশালী বিবর্তনীয় শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, সে আপনি বিবর্তন বুঝুন না বুঝুন, মানুন কিংবা না মানুন।

লেখক: তিকতালিকীয় সদস্যবৃন্দ

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *