জ্বর হলেই কি তৎক্ষণাৎ ঔষধ খাওয়া উচিত?

জ্বর হলেই কি তৎক্ষণাৎ ঔষধ খাওয়া উচিত?

জুলিয়াস ওয়াগনার-জুরেগ নামক একজন অষ্ট্রিয়ান চিকিৎসক গত শতাব্দীর শুরুতে মারাত্মক এক পাগলামি করেন। তিনি হাজার হাজার সিফিলিস রোগীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত করান। সিফিলিস এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন যা যৌনমিলনের মাধ্যমে এক ব্যক্তি হতে আরেক ব্যক্তিতে ছড়ায়। সহজ কথায় এক ধরনের যৌনরোগ। ওই সময়ে সিফিলিস রোগের আহামরী কোনো চিকিৎসা ছিলো না, ফলে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে তার সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হওয়া একপ্রকার অসম্ভব কার্য হয়ে যেতো। জুরেগ সাহেবের মাথায় এই পাগলামি মূলত চাপছিলো অন্য আরেক ঘটনা থেকে। জুরেগ সাহেব লক্ষ্য করেন, একটা এলাকায় যেখানে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বেশি সেখানে সিফিলিস রোগ একেবারে নাই বললেই চলে। আবার, তার কিছু সিফিলিস আক্রান্ত রোগী ম্যালেরিয়া জ্বর হওয়ার পরে সিফিলিস থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিলো। এই দুইয়ে দুইয়ে চার করা ঘটনা থেকে তিনি উদ্বুদ্ধ হন এই পরীক্ষা করে দেখতে। এই ধরনের পরীক্ষা আসলে খুবই বিপজ্জনক, যদি কোনোভাবে হিতে বিপরীত হতো তবে ওই হাজারো রোগী একই সাথে সিফিলিস-ম্যালেরিয়ার জটিল আক্রমণে জীবন সংকটে পড়ে যেতো।


ভাগ্য সহায়, এই পরীক্ষায় হিতে বিপরীত কিছু ঘটেনি। বরং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে সিফিলিস রোগীরা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে শুরু করে। জুরেগ সাহেবের এই পাগলামি তাকে ১৯২৭ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার এনে দেয় এবং প্রথমবারের মতো আমাদের সাধারণ জীবন-যাপনে জ্বর যে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে তা বিশ্বব্যাপী সাধারণ জনগণ এবং গবেষকদের নজরে চলে আসে। এর প্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে জ্বর নিয়ে আরও কিছু হিউম্যান-স্টাডি হয়। যেমন: বেশ কিছু চিকেন পক্সে আক্রান্ত বাচ্চাকে ভলেন্টিয়ার হিসেবে বাছাই করা হয়। তাদের মধ্যে কিছু বাচ্চাকে জ্বর কমানোর ওষুধ দেওয়া হলেও বেশ কিছু বাচ্চাকে ওষুধের নামে সাধারণ চিনির ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। দেখা যায়, যাদের জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে তারা সুস্থ হচ্ছে তুলনামূলক দেরীতে। কিন্তু যাদের কোনোপ্রকার ওষুধ দেওয়া হচ্ছেনা, তারা সুস্থ হচ্ছে গড়ে প্রায় ২৪-৪৮ ঘন্টা আগেই। একই ধরনের আরেকটা গবেষণার গল্প বলি। ৫৬ জন ভলিন্টিয়ারকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইনফেকশনে আক্রান্ত করানো হয় এক ধরনের নাসাল স্প্রের মাধ্যমে। এরপর তাদের কয়েকজনকে অ্যাসপিরিন তথা জ্বর ভাগানোর ওষুধ এবং বাকীদের ওষুধের নামে সাধারণ ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। ফলাফল ঠিক আগের মতোই। ওষুধ খাওয়া রোগীদের তুলনায় ওষুধ না খাওয়া রোগীদের অ্যান্টিবডি বেশি কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং তাদের ইনফেকশন দ্রুত ঠিক হয়ে যাচ্ছে।


এই দু-একটা গবেষণা জ্বর হলে ওষুধ খাওয়া উচিত কি অনুচিত তার উত্তরের জন্য যথেষ্ট না। জ্বর আসলেই আমাদের জন্য ভালো কিনা সেটা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে জ্বরের ইতিহাসের দিকে। আমরাও আর ১০ টা প্রাণীর মতো একটা প্রাণী, জ্বর যদি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনে তবে অন্যান্য প্রাণীতেও নিশ্চয়ই এর একটা ভালো প্রভাব দেখা যাবে। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী, জ্বরের গুরুত্ব বুঝতে তাই স্তন্যপায়ীদের দিকেই তাকানো যাক। খরগোশ যখন বাচ্চা থাকে তখন এদের শরীরে জ্বর হয়না, তারা ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে কৃত্রিমভাবে জ্বর জ্বর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা একটা উষ্ণ পরিবেশ খুঁজে বের করে এবং সেখানে অবস্থান করে নিজের শরীরের তাপমাত্রা সাধারণের তুলনায় প্রায় ২-৩ ডিগ্রী বাড়ায়। প্রাপ্তবয়স্ক খরগোশের ক্ষেত্রে, রোগ আক্রান্ত শরীরেই জ্বর উৎপন্ন হয়। প্লেগ ভাইরাসে আক্রান্ত খরগোশের ক্ষেত্রে যদি জ্বর কমানোর ওষুধ দেওয়া হয় তবে মৃত্যুহার বেড়ে প্রায় ৭০% হয়ে যায় যেখানে কোনোপ্রকার ওষুধ না দিয়ে জ্বর থাকতে দিলে মৃত্যুহার হয় মাত্র ১৬%। ইঁদুরের ক্ষেত্রে, যদি ২ ডিগ্রী জ্বরওয়ালা ইঁদুর যদি কোনো গরম ঘরে রাখা হয় তবে এদের শরীরের কুলিং মেকানিজম ওই ২ ডিগ্রী জ্বর বজায় রাখে। আবার, যদি কোনো ঠাণ্ডা ঘরে রাখা হয় তবে তাদের শরীরের তাপ উৎপাদন মেকানিজম চালু হয় এবং সেই ২ ডিগ্রী জ্বরই বজায় থাকে। এ থেকে সহজে বোঝা যায় ২ ডিগ্রী জ্বর বজায় থাকাটা ইঁদুরের বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য কতটা জরুরী!


আমরা যদি আরও বড় পরিসরে খেয়াল করি তবে স্তন্যপায়ী ছাড়া অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীতে (মাছ, সরিসৃপ) কিংবা পোকামাকাড়ের মতো শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীতেও টিকে থাকার অভিপ্রায়ে শরীরে জ্বর সৃষ্টি হওয়ার মতন ঘটনা দেখা যায়। তবে সেটা হয় কৃত্রিমভাবে, উপরের ওই বাচ্চা খরগোশের মতো উপায় অবলম্বন করে। মাছিরা কৃত্রিম জ্বরের জন্য নিজেদের চাকের তাপমাত্রা বাড়ায় এর ভিতরে নানারকম শারীরিক কসরত করে। ডিজার্ট ইগুয়ানা নামক এক ধরনের সরিসৃপ এরকম কৃত্রিমভাবে নিজের শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায় যখন তারা হাইড্রোফিলা নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। যদি তাদের এই শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে দেওয়া না হয় তবে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৭৫% (!) কমে আসে। একইরকম ঘটনা দেখা যায় টুনামাছ এবং জোঁকের ক্ষেত্রেও।


মূলত আমাদের জ্বর হলো এক ধরনের কোপিং মেকানিজম যা কমপক্ষে ৬০০ মিলিয়ন বছর (তারও আগে থেকেই হয়তো) ধরে প্রাণীতে তথা ভার্টিব্রেট কিংবা ইনসেক্টসদের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছে। যেসব প্রাণীদের শরীরে মেটাবলিজম হয়না তাদের জ্বর সৃষ্টির জন্য অন্য উপায় খুঁজে নিতে হয়, পুঁথিগত ভাষায় এসব উপায়কে বলে- “Behavioural Regulation”। যাদের শরীরে মেটাবলিজম হয় অর্থাৎ উষ্ণ রক্তের প্রাণীর ক্ষেত্রে মেটাবলিজমের হার বৃদ্ধির মাধ্যমেই জ্বরের সৃষ্টি হয়। এই জ্বর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলে। যেমন: স্তন্যপায়ীদের জ্বরের ফলে এদের শরীরে থাকা পোলিওভাইরাসের বংশবৃদ্ধি একদম কমে যায়, এবং আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। মানুষের ক্ষেত্রেই জ্বর নিয়ে দুটো ঘটনা আমরা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছি। আরেকটা ঘটনা বলি, ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত রোগীদের যদি এন্টিপাইরেটিক ওষুধের মাধ্যমে জ্বর কমানো হয় তবে ৫% অবদি মৃত্যহার বেড়ে যায়। এখনো অবদি যা যা গবেষণার কথা উল্লেখ করলাম তা থেকে এটাই বোঝা যায় জ্বর বিবর্তনের ধারায় টিকে যাওয়া এমন এক মেকানিজম যা ইনফেকশনের সময় অণুজীবদের বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধের মাধ্যমে মৃত্যুহার কমায় এবং কোনো প্রাণীর তথা পপুলেশনের টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। এটা না থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুহার এত বেশি ঘটতো যে অচিরেই সেই গোষ্ঠী তথা প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতো। ১-৪ ডিগ্রী অবদি জ্বর আপনাকে নানাধরনের ইনফেকশন এবং স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে রক্ষা করে থাকে। তাই কিছু থেকে কিছু হওয়ার আগে প্যারাসিটেমল জাতীয় ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। যেতে যেতে একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান। এই যে জ্বরের ইতিহাস জানলাম, দৈনন্দিন জীবনে জ্বরের গুরুত্ব অনুধাবন করলাম, যদি বিবর্তনতত্ত্ব আর স্তন্যপায়ীদের মিলিয়ন বছরের ইতিহাস, অভিযোজন, ফ্যামিলি ট্রি না থাকতো চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে, তবে সুস্থ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এত বড় রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হতো কী করে? এরকম আরও তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পড়তে আমাদের সাথে থাকুন।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *