অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের অনুভূতি আছে কিনা এটা খুব বড় একটা বিতর্কের বিষয় বিজ্ঞান দুনিয়ায়, এটা যে শুধু একটা ডিসিপ্লিনের ভাবনার বিষয় এমন না; পতঙ্গবিদ্যা, আচরণবিদ্যা, স্নায়ুবিদ্যা, প্রাইমেটোলজি সহ বহু বহু ক্ষেত্র জড়িয়ে আছে এই এক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সাথে। গত এক দুই দশক আগেও প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা হতো অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন কাঁকড়া, অক্টোপাস কিংবা স্কুইড কিংবা কোনে পতঙ্গ- এদের কোনোরকম কোনোপ্রকার অনুভূতি নেই। কিন্তু এখন আর দৃষ্টিভঙ্গী তেমন নাই। অধুনিক গবেষণা আমাদের জানান দেয়, তাদেরও অনুভূতি আছে, এই অনুভূতি শুধু সুখ কিংবা দুঃখের নয়, হয়তো তারা ক্রোধ, ভালোবাসার মতো জটিল জটিল অনুভূতিগুলোও ধারণ করে।
২০২০ সালে মুক্তি পাওয়া ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র “My Octopus Teacher” এ দেখা যায় অক্টোপাস রোবোটের মতো শুধু খায়, দায়, শিকার করে, নিজেকে রক্ষা করে এমন কিন্তু না। অক্টোপাস মাছেদের সাথে ঘুরে ঘুরে খেলা করে, নেচে বেড়ায়, আনন্দ করে। শিকারকে কুপোকাত করার পরে কিংবা নিজেকে শিকারীর হাত থেকে রক্ষার পর গর্বের সাথে উল্লাসও করে। শিকার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কৌশলও বানায়। এসব থেকে এক ধাপ উপরে, অক্টোপাস মানুষের সাথে ইমোশনালি অ্যাটাচডও হতে পারে, উক্ত ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রেইগ ফস্টারের সাথেও এমনই হয়েছিলো। তিনি একবছর একটা অক্টোপাসের সাথে কাটিয়েছেেন, এক পর্যায়ে সেই অক্টোপাস ক্রেইগকে নিজের আপনজন বন্ধু ভেবে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে শুরু করে; আমাদের পোষা প্রাণীগুলোর মতোই।
অক্টোপাস ছাড়াও কাঁকড়া, লবস্টার জাতীয় অমেরুদণ্ডীর মধ্যেও একইরকম অনুভূতির অস্তিত্ব শনাক্ত করা যায়। ফ্রান্সিস ডি ওয়াল, যিনি প্রাইমেটদের আচরণ নিয়ে গবেষণা এবং বইয়ের জন্য বিখ্যাত, তার কলিগ ক্রিস্টিন অ্যান্ড্রিউর সাথে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের অনুভূতি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেন সাইন্স জার্নালে, ২০২২ সালে। সেখানে ওয়াল বলেন, “অনুভূতিকে যদি আমরা বিভিন্ন অবস্থায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়ার অভিযোজন হিসেবে চিন্তা করি তাহলে সেটা অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণীতেই দেখা যায়, বিশেষ করে চিংড়ি, কাঁকড়া কিংবা অক্টোপাসে।” ২০০০ সালের এলউডের কাঁকড়া নিয়ে গবেষণার ফলাফল কিংবা উপসংহারও কিছুটা এরকমই ছিলো। তিনি কাঁকড়া শরীরে অ্যাসিটিক অ্যাসিড লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে দেখা যায় এই অ্যাসিডের দরুণ হওয়া ব্যথা দূর করতে কাঁকড়াটা নিজের শরীর কাঁচের সাথে বারবার ঘষছে, ঘষে অ্যাসিড দূর করছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় কাঁকড়ার ব্যথা অনুভবে ক্ষমতা আছে। এখন প্রশ্ন এই অনুভূতি ঠিক কতটা বেশি? এই ব্যথার অনুভূতি শুধুই একটা প্রতিবর্তী প্রক্রিয়া নাকি কাঁকড়া এইসব ব্যথার অনুভূতি থেকে কিছু শিক্ষা নিয়ে থাকে? উত্তর হলো, হ্যাঁ। এলউড ওই কাঁকড়াকে যখন বৈদ্যুতিক শক প্রদান করেন, দেখা যায়, বৈদ্যুতিক শক থেকে বাঁচতে কাঁকড়াটি নিজের আচরণ, চলার পথে পরিবর্তন এনেছে। একটু বিস্তারিত বলি।
এলউড একটা বড় পানিহীন অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে সমুদ্রের তীরের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তারপর সেখানে দুটো ছোটো ছোটো আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গা রাখেন। কাঁকড়া নিজেদের রক্ষার জন্য সাধারণ পাথর কিংবা বড় কিছুর পিছনে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। এটা তাদের বংশগত আচরণ। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। কাঁকড়াটাকে যখনই অ্যাকুইরিয়ামের মাঝামাঝি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সে দৌড়ে চলে গেছে এক কোণায় নিজেকে লুকিয়ে আশ্রয় নিতে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সাথে সাথে যখনই বৈদ্যুতিক শক লেগেছে তখনই সে নিজের আগের আশ্রয় ছেড়ে অন্য আশ্রয়ে চলে গেছে। উভয় আশ্রয়ে বৈদ্যুতিক শক লাগার পর দেখা গেছে কাঁকড়া আর কোনো আশ্রয়কেন্দ্রেই আশ্রয় নিচ্ছেনা। বরং খোলা ময়দানে থাকাই বেশি নিরাপদ মনে করছে। এ থেকে বোঝা যায়, কাঁকড়াদের এই ব্যাথার অনুভূতি যথেষ্ট জটিল, তারা এটা থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং হয়তো চিন্তাভাবনাও করতে পারে।
কয়েকদিন আগেই, ২০২৪ এর ২২ অক্টোবর MDPI তে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে কাঁকড়ার ইলেক্ট্রোফিজিওলজিক্যাল আচরণ নিয়ে আলাপ করা হয়েছে। এটাই প্রথম গবেষণা যেখানে অম্ল (অ্যাসিটিক অ্যাসিড) প্রয়োগ করে কাঁকড়ার ইলেক্ট্রোফিজিওলজিক্যাল পরিবর্তন শনাক্ত করা হয়েছে। দেখা গেছে, কাঁকড়ার শরীরে কমপক্ষে ৩২ টি এলাকা রয়েছে যা অম্লের মতো প্রদাহী রাসায়নিকের প্রভাবে সাড়া প্রদান করে। এসময় স্নায়ুতন্ত্রে আলোড়ন তৈরী হয় এবং খুব সম্ভবত তারাও আমাদের মতো ব্যথায় ভোগে। তবে এখনো এ নিয়ে বহু গবেষণা বাকী, সব বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে একমত নন।
পোকামাকড় কিংবা এরকম অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্র আমাদের মতো উন্নত নয়। তাই তারা “অনুভব” করতে পারে কিংবা আমাদের মতো তাদেরও “ইমোশন” আছে এমনটা বলতে নারাজ স্নায়ুবিশেষজ্ঞ ক্যারেন ম্যাশ্চে কিংবা পতঙ্গবিশেষজ্ঞ ডেভিড ম্যারিট। আসলে তাদের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, তাদের যুক্তিতে, অমেরুদণ্ডীরা বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায় এটা তাদের রাসায়নিক প্রতিবর্তী ক্রিয়া মাত্র। তারা এটা নিয়ে আমাদের মতো চিন্তা করতে পারে কিংবা আমাদের মতোই অনুভব করতে পারে এমনটা কখনোই সত্য নয়, আমাদের স্নায়ুতন্ত্র যতটা উন্নত তাদের তেমন উন্নত না। ফলে তাদের বিভিন্ন আচরণ দেখে আমরা যেটা ভাবছি সেটা আমরা মানুষরাই অনুভব করছি আমাদের অনুভবের সক্ষমতা আছে বলে, তারা করছে না। তো পাঠকগণ, আপনাদের কী মনে হয়? কাঁকড়াদের আসলেই ব্যথা, ভালোবাসার মতো অনুভূতি রয়েছে?