ডায়ার ওলফ কি অবশেষে পৃথিবীতে ফিরলো?

ডায়ার ওলফ কি অবশেষে পৃথিবীতে ফিরলো?

খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৮০০ বছর আগের কথা। তখনও প্রবল প্রভাবশালী রোম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়নি। ইতালির ‘আলবা লংগা’ নামক এক প্রাচীন শহরে রাজত্ব করতো রাজা নুমিটর। রাজা নুমিটরের ছিল আমুলিয়াস নামে এক ছোট ভাই। আর সব কাহিনীর মতো ক্ষমতার দখলের জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে নুমিটরের ছোটভাই আমুলিয়াস। এক সময় সফলও হয় সে। সিংহাসন দখল করে নেয় আমুলিয়াস। হত্যা করা হয় নুমিটরকে। নুমিটরের রিয়া সিলভিয়া নামক এক কন্যা ছিল। আমুলিয়াস ষড়যন্ত্র করে তাকে একটি প্রথা পালনের জন্য জোরাজুরি শুরু করে। ‘ভেস্টাল ভার্জিন’ নামক এই প্রথায় নারীরা সাধারণত ৩০ বছর পর্যন্ত বিয়ে না করে দেবতার সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করে। এর ফলে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তা করার আর কোনো কারণ থাকে না আমুলিয়াস এর কাছে। আমুলিয়াস নিশ্চিন্ত হলেও ঈশ্বর যেন পতনই লিখে রেখেছিল তার ভাগ্যে। আর তাই তো যুদ্ধের দেবতা ‘মঙ্গল’ এর আশীর্বাদে সিলভিয়ার গর্ভ সংযোগ হয় এবং দুটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় সিলভিয়া।


পুত্র সন্তান জন্মের সংবাদে রেগে যায় আমুলিয়াস। তার কর্মচারীদের তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দেয় বাচ্চা দুটিকে হত্যা করার জন্য। তবে ঈশ্বরের আশীর্বাদে অথবা ভাগ্যগুণে,যেভাবেই হোক; বাচ্চা দুটি রক্ষা পায়। তাদের যেই পাত্রে করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটি ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছায় প্রাচীন এক ফিগ গাছের নিচে। এক নেকড়ে মা উদ্ধার করে বাচ্চা দুটিকে এবং নিজের সন্তানের মতো পালন করতে শুরু করে। দিন কাটে-মাস কাটে। নেকড়ে মাতার আদরে বেড়ে উঠতে থাকে রমুলাস ও রেমাস; দেবতা ‘মঙ্গল’ এর দুই সন্তান। একসময় যখন যুবক বয়সে পৌঁছায়, তখন তারা জানতে পারে তাদের আসল পরিচয়। ফিরে যায় নিজেদের রাজসিংহাসন উদ্ধারকার্যে। হ্যাঁ, আমুলিয়াস’কে হারিয়ে নিজেদের দাদা’র সিংহাসন উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তারা। এই রমুলাস ই পরবর্তীতে রোম সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। যদিও এটা মিথোলজি, তবে এরকম প্রাণীদের দ্বারা মানুষের বেড়ে উঠা নিয়ে অনেক সত্যি ঘটনা আছে। সেগুলো নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে। তবে আজকে আমাদের রূপকথার গল্পের নায়ক কিন্তু এই রমুলাস, রেমাসই। হ্যাঁ,ঘটনা সত্যি হলেও সেটা রূপকথাকেও হার মানায়। প্রায় সাড়ে বারো হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ‘ডায়ার ওলফ’দের ফিরিয়ে এনেছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন করে তিনটি নেকড়ের বাচ্চা’র জন্মের কথা প্রকাশ করে ‘কলোসাল বায়োসায়েন্স’ নামক একটি বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান। আর এতেই সাড়া পড়ে যায় নেট দুনিয়ায়।


এইচবিও’র টিভি সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’ অনেকেই দেখে থাকবেন। সেখানে হাউজ স্টার্কের প্রতিনিধি ছিল এক ধরণের সাদা নেকড়ে। এরা ছিল নেড স্টার্কের প্রতিটি সন্তানের সঙ্গী এবং রক্ষাকর্তাও। এদেরই বলা হয় ডায়ার ওলফ। আজ থেকে প্রায় ১.২৫ লক্ষ বছর আগের কথা। পৃথিবীতে তখনও মানুষের বেশ কয়েকটি প্রজাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই যেমনঃ হোমো নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভান মানুষ ইত্যাদি৷ তাদের পাশাপাশি আরো কিছু শিকারি প্রাণীও ঘুরে বেড়াচ্ছে জঙ্গলে ও পাহাড়ে। এদের মধ্যে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রাণী হলো ‘ডায়ার ওল্ফ’। এদের বাংলা করলে হয় ‘ভয়ঙ্কর নেকড়ে’। হ্যাঁ, এই সাদা নেকড়ে বর্তমানের ধূসর নেকড়ের চেয়ে আকারে বড়, মাথা চওড়া, মোটা লোমে ঢাকা ও চোয়াল অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। এদের দাঁতের আকার ছিল বর্তমান নেকড়েদের চেয়ে অনেক বড়। ১৮৫৪ সালে আমেরিকার লস এঞ্জেলসে প্রথম এদের ফসিল পাওয়া যায়। ১৮৫৮ সালে এই প্রজাতির নামকরণ করা হয়। এই প্রথম মানুষ জানতে পারে ডায়ার ওল্ফ সম্পর্কে। লস এঞ্জেলসেই পরপর আরো প্রায় অনেকগুলো ফসিল পাওয়া যায়। সেই ফসিলগুলো থেকেই ধারণা করা হয় যে, এখন থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে এদের বিলুপ্তি ঘটেছিল। লস এঞ্জেলস এ পাওয়া কিছু ফসিল একদম নতুন ছিল। আর সেরকম পাঁচটি ফসিল থেকে ২০২১ সালে ডায়ার ওল্ফ এর আংশিক জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়। এরপর এদের নিয়ে শুরু হয় নানা ধরণের গবেষণা। ফিরিয়ে আনার নানা ধরণের চেষ্টা করা হয়।


ডায়ার ওল্ফ ফিরিয়ে আনার প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ স্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসভিত্তিক বায়োটেক প্রতিষ্ঠান কলোসাল বায়োসায়েন্স। আর এরাই গত ৮ এপ্রিল, ২০২৫ দাবি করে যে, তারা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে ডায়ার ওল্ফ’দের এবং এটি পৃথিবীর প্রথম সফলভাবে পুনর্জীবিত হওয়া বিলুপ্ত প্রাণী। এই প্রতিষ্ঠান ২০২১ সাল থেকেই দাবি করেছিল যে, বিলুপ্ত ম্যামথ, ডোডো এবং তাসমানীয় বাঘ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। তবে ডায়ার ওলফ নিয়ে তাদের কাজ এতদিন গোপন ছিল। অবশেষে তারা জনসম্মুখে নিয়ে আসে ডায়ার ওল্ফের তিন বাচ্চা’কে। এর মধ্যে পুরুষ বাচ্চা দুটির নাম রাখা হয় রমুলাস এবং রেমাস এবং নারী বাচ্চাটির নাম রাখা হয় ‘খালেসি’( ‘গেইম অফ থ্রোনস’ থেকে এই নাম নেওয়া হয়েছে)। পুরুষ বাচ্চাগুলোর বয়স ছয় মাস,অন্যদিকে খালেসি’র বয়স মাত্র দুই মাস। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বেন লাম জানান, তাদের বিজ্ঞানীরা প্রায় ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত ও ৭২ হাজার বছর পুরোনো একটি খুলি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে সেখানে জিনগত পরিবর্তন সাধন করেছে। এরপর সেই ডিএনএ ব্যবহার করেই ফিরিয়ে এনেছে এই ডায়ার ওল্ফ’দের।


তবে বেন লাম যত সহজে এই কথা বলেছে, মূল ব্যাপারটা কিন্তু অতটা সোজা নয়। এমনকি তাদের এই ঘোষণায় অনেক ফাঁকিও রয়েছে। সেগুলো বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম ক্লোন করা প্রাণী ডলি’র কথা আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন (না জানলে গুগল করেন)। তো সেই ক্লোনিং প্রক্রিয়া কিন্তু বেশি জটিল কিছু না। প্রথমে দাতা’র টিস্যু থেকে একটি কোষ আলাদা করা হয়। তারপর সেই কোষের নিউক্লিয়াস নিয়ে অন্য প্রাণীর ডিম্বাণু’র মধ্যে স্থাপন করা হয় (এক্ষেত্রে অবশ্যই একই প্রজাতি হতে হবে)। তারপর সেই ডিম্বাণু’কে নিষিক্ত করে ‘সারোগেট মাদার’ এর গর্ভাশয়ে স্থাপন করা হয়। ব্যস! দাতা’র একটি ক্লোন বেরিয়ে আসে। তবে বিলুপ্ত প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা আরেকটু জটিল। ডায়ার ওল্ফের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ১৩,০০০ বছরের পুরনো দাঁত এবং ৭২,০০০ বছরের পুরনো খুলি থেকে ১৪ টি জিনের মধ্যে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ জিনগত পার্থক্য শনাক্ত করেন, যা ডায়ার ওল্ফকে ধূসর নেকড়ে থেকে পৃথক করে তোলে। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল বৃহৎ আকার, সাদা লোম, প্রশস্ত মাথা, বড় দাঁত, গর্জন ইত্যাদি। মূলত, এসব বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী জিনগুলোকে শনাক্ত করে আলাদা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তারপর তারা করলেন কী, গ্রে ওল্ফ এর রক্ত থেকে কিছু টিস্যু আলাদা করে নিলেন। সেই কোষের মধ্যেই CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাটাকুটি করে সেই ১৪ টি জিন সম্পাদনা করলেন। এতেই সেই কোষে যুক্ত হয়ে গেলো ডায়ার ওল্ফের বৈশিষ্ট্যগুলো। পড়তে যতটা সহজ মনে হলো ততটাও সহজ নয় কিন্তু। এই জিন সম্পাদনা’র ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যেই নানা ভুল হয়, কিছু জিন আবার এমন সব বৈশিষ্ট্যর সৃষ্টি করে যা গ্রহীতার মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। ডায়ার ওল্ফেরও এরকম তিনটি জিন ছিল যেগুলো তাদের গায়ের রঙের জন্য দায়ী, আবার ধূসর নেকড়ের ক্ষেত্রে সেই জিনগুলো অন্ধত্ব এবং বধিরতা’র জন্যও দায়ী ছিল। তাই বিজ্ঞানীদের খুব সাবধানে এসব জিন সম্পাদনা করতে হয়েছে।


তো রক্তটিস্যু’তে জিন সম্পাদনা হয়ে গেলে কোষের নিউক্লিও বস্তুগুলোকে আলাদা করে ধূসর নেকড়ের ডিম্বাণুতে পাচার করা হয়। এরপর সেগুলোকে নিষিক্ত করে ক্লোন করা হয় এবং দেশীয় হাউন্ড জাতের কুকুরের গর্ভাশয়ে স্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা। ডায়ার ওল্ফের জন্মদানের ক্ষেত্রে দুইটি সারোগেট কুকুর ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কলোসাল বায়োসায়েন্স। অবশেষে, সব কৃত্রিম কাজকারবার শেষে একটু জিরিয়ে নিল বিজ্ঞানীরা। ঠিক ৬৫ দিনের মাথায় জন্ম হলো প্রাগৈতিহাসিক দুই প্রাণী রমুলাস ও রেমাস এর। কয়েকমাস পর পৃথিবীতে আসলো খালেসি। এই নতুন নেকড়ে বাচ্চাগুলো আসলে ধূসর নেকড়ের। এমনকি ধূসর নেকড়ের সাথে এদের ৯৯.৯ শতাংশ মিল রয়েছে, শুধু সামান্য কিছু জিন ছাড়া। বিজ্ঞানীরা মূলত ডায়ার ওল্ফের কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য মিমিক করলো। এই গবেষণায় অনেক কিন্তু থাকলেও এতগুলো বৈশিষ্ট্য পুনরায় ফিরিয়ে আনার ঘটনা এই প্রথম। তাই এত আলাপ-আলোচনা এই আবিষ্কার নিয়ে।


সর্বশেষ আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ডায়ার ওল্ফ’দের পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না? এর সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ডায়ার ওল্ফের পুরোপুরি জিনোম সিকোয়েন্স এখনো রিকনস্ট্রাক্ট করা সম্ভব হয়নি। এমনকি, পুরোপুরি জিনোম পাওয়া অসম্ভব প্রায়। কিছু ক্ষেত্রে সেটা গেলেও কোষ পাবে না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য ডিম্বাণুতে বসাতে হবে। এপিজেনেটিক্স মিলবে না। অর্থাৎ, কখনোই ১০০% বিশুদ্ধ ডায়ার ওল্ফ কিংবা বিলুপ্ত প্রাণী আপনি দেখতে পাবেন না। তাই মন খারাপ না করে যেটুকু পাওয়া গিয়েছে সেটাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

শেষ করার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে ভাবা যাক। এই গ্রে ওল্ফের বাচ্চাগুলোকে কুকুরের গর্ভাশয়ে জন্ম দিতে হলো কেনো? গ্রে ওল্ফের গর্ভে জন্ম হলে কী হতো? এর সবচেয়ে সহজ সরল উত্তর হলো, কুকুর এবং গ্রে ওল্ফ একই প্রজাতির। তাই, গ্রে ওল্ফের গর্ভাশয়েই রাখতে হবে এমন কোনো কথা নাই। তার উপর গ্রে ওল্ফ বা নেকড়ে একটি বন্য প্রাণী, ফলে তাদের আটকানো, টেমে রাখা বা গর্ভধারণে ব্যবহার করা অত্যন্ত কঠিন। তারা সহজে মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে বন্দী থেকে, আগ্রাসী হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসা বা গবেষণার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। এদিকে গৃহপালিত কুকুর অনেকটাই সহনশীল, পরিচিত ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য।


দ্বিতীয়ত, জেনেটিক মিল। গ্রে ওল্ফ ও কুকুরের ডিএনএ-র ৯৯.৯৯% মিলে যায়। তারা মূলত একই প্রজাতির ভিন্ন রূপ। তাই কুকুরের গর্ভাশয় ডায়ার ওল্ফের জেনেটিক মোডিফাইড ভ্রূণের জন্য বেশ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাদের গর্ভকালীন সময়, শরীরের গঠন, এমনকি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মিল আছে। পুনশ্চ, এখন এই তিনটি নেকড়ে ছানা বসবাস করছে এক গোপন স্থানে, ২ হাজার একরের একটি নিরাপদ এলাকায়। ১০ ফুট উঁচু বেড়ায় ঘেরা সেই এলাকায় রয়েছে আধুনিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, প্রহরী ও ড্রোন নজরদারি। কলোসাল জানায়, এই স্থাপনাটি আমেরিকান হিউম্যান সোসাইটির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের নিবন্ধিত। কলোসাল এর আরো কিছু লক্ষ্য রয়েছে। যেমনঃ ২০২৮ সালের মধ্যে একই প্রক্রিয়ার মাধ্যেম ম্যামথ’কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ভবিষ্যতই বলে দেবে, তাদের এই প্রক্রিয়া কতটা সফল হয়!

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *