আমাদের আশেপাশের মানুষদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, কয়েক হাজার বছর আগেও মানুষ অনেক লম্বা ছিল; কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের উচ্চতা কমছে। এক্ষেত্রে তারা পিরামিডের কথা উল্লেখ করে। সেসময় নাকি দৈত্যাকার মানুষেরা পিরামিড তৈরি করেছিল। আসলেই কি মানুষ আগে অনেক লম্বা ছিল? দিন দিন কি তাদের উচ্চতা কমেছে? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
উপরের দুটি প্রশ্নের এককথায় উত্তর হলো, ‘না’! প্রাচীনকালে কিংবা কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ লম্বা তো ছিলোই না বরং এখনকার চেয়ে অনেক খাটো ছিল। দিন দিন মানুষের গড় উচ্চতা বেড়েছে। মানুষের উচ্চতার ৮০ শতাংশই নির্ভর করে জিনের উপর (ডিএনএ এর ক্ষুদ্রতম অংশ)। এখন পর্যন্ত মানুষের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণকারী প্রায় ১২ হাজার জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট এর খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এগুলো আলাদা আলাদাভাবে মানুষের উচ্চতাবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
এছাড়াও পরিবেশের প্রভাব, উন্নত খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদিও মানুষের উচ্চতাবৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাই বলে কোনো মানুষের অস্বাভাবিক হারে লম্বা হয়ে দৈত্যাকার হওয়া সম্ভব নয়। পদার্থবিজ্ঞানে ‘Square-cube law’ নামক একটি নিয়ম রয়েছে। এই law অনুসারে কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য যতগুণ বৃদ্ধি পাবে, তার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পাবে ‘দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির বর্গের সমানুপাতে’ এবং আয়তন বাড়বে ‘ঘনের সমানুপাতে’। মানে হলো যদি কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য ২ গুণ হয় তবে তার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বাড়বে ৪ গুণ, আর আয়তন ও ওজন বাড়বে ৮ গুণ।
এখন যদি মানুষের উচ্চতা ৬০ ফুট হয়, মানে বর্তমানের চেয়ে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়, তবে পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল ১০০গুণ আর আয়তন ও ওজন বাড়বে ১০০০ গুণ। অর্থাৎ ভার বহনকারী হাড়গুলোর আগের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ওজন বহন করতে হবে। ফলে হাঁটার সময় মানুষের হাড় ভেঙে যাবে। এছাড়াও শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা,স্নায়বিক সমস্যা সহ নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিবে। তাই এত লম্বা মানুষ কখনোই সম্ভব নয়। বাস্তবে এযাবৎ কালের সবচাইতে লম্বা মানুষ ছিলেন Robert wadlow (৮ফুট ১১ইঞ্চি) এবং বর্তমানে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার অধিকারী টার্কিশ সুলতান কোসেন (৮ফুট ৩ইঞ্চি)।
এবার কথা বলবো উচ্চতা সম্পর্কিত কিছু গুজব নিয়ে। অনেকে পিরামিড এর কথা উল্লেখ করে বলে যে, বিশাল মানুষেরা পিরামিড তৈরি করেছে কিংবা মিশরের ফারাও রাজা’রা (ফেরাউন) অনেক লম্বা ছিল। কিন্তু আসলে পিরামিড তৈরি করেছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরাই। অনেক প্রমাণ রয়েছে এসবের। যেকেউ ইন্টারনেট ঘেঁটে সহজেই এসব তথ্য বের করতে পারবে। আবার, মিশরের শাসকদের বলা হতো ফারাও বা ফেরাউন। এদের গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি’র মধ্যে। রাজা ২য় রামেসিস; যাকে হযরত মুসা (আঃ) এর সময়কালের ফেরাউন বলে ধারণা করা হয়, তারও উচ্চতা ছিল মাত্র ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি’র মতো। অর্থাৎ,কেউই অস্বাভাবিক উচ্চতার ছিলো না। এছাড়াও মাঝে মাঝে দৈত্যাকার মানুষের হাড়গোড় পাওয়ার গুজব উঠে। সেগুলো বেশিরভাগই ফেইক হয় কিংবা বড় কোনো প্রাণী যেমনঃ হাতি,ম্যামথ,ডাইনোসর ইত্যাদির হয়ে থাকে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে গুজব খুব সহজেই ছড়ায় তেমনি সেসব গুজবের বিরুদ্ধে নানা প্রমাণও খুঁজলে সহজে পাওয়া যায়। তাই যেকোনো তথ্যের সত্যতা নিশ্চিতের জন্য আমাদের কারো কথায় বিশ্বাস না করে নিজের হাতের স্মার্টফোন ব্যবহার করা উচিত!
আমরা যদি সময়ের সাথে পিছনের দিকে যেতে থাকি তাহলে দেখতে পাবো যে, মানুষের পূর্বপুরুষেরা অতটা লম্বা ছিলো না। এখানে পূর্বপুরুষ বলতে কয়েক হাজার বছর আগের মানুষদের বোঝানো হয়নি; বরং কয়েক লক্ষ বছর আগের মানুষের অন্য প্রজাতিদের বোঝানো হয়েছে। আমরা ‘হোমো সেপিয়েন্স’ প্রজাতির মানুষ। ‘হোমো’ গণের এরকম আরো অনেকগুলো প্রজাতি ছিল। যেমনঃ হোমো ইরেক্টাস,হোমো হাবিলিস,হোমো অর্গাস্টার, হোমো নালেডি, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস ইত্যাদি। এখন থেকে মাত্র ৩ লক্ষ বছর আগে মানুষের ৯ টা প্রজাতি (হোমো গণের) পৃথিবীতে একসাথে বসবাস করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে শুধু টিকে যায় হোমো সেপিয়েন্স’রা। যাহোক, এসব প্রজাতির মানুষেরা কিন্তু লম্বায় বর্তমান মানুষের (হোমো সেপিয়েন্স) চেয়ে অনেক খাটো ছিল।
২৫ লক্ষ বছর আগে উদ্ভব ঘটেছিল হোমো গণের একটি প্রজাতি ‘হোমো হাবিলিস’দের। এদের উচ্চতা ছিল মাত্র ৩ ফুট ৩ ইঞ্চি – ৩ ফুট ১১ ইঞ্চি। এরপর ২০ লক্ষ বছর আগে আসে হোমো ইরেক্টাসরা। এদের উচ্চতা ছিল সাড়ে চার ফুটের বেশি। এরপর ১৫ লক্ষ বছর আগে আসে ‘হোমো অর্গাস্টার’রা। এরা আবার লম্বায় ৫ ফুটের চেয়ে বেশি ছিল। কিছু কিছু অর্গাস্টার’রা অবশ্য ৬ ফুটের চেয়ে বেশি ছিল বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এত দূরে না গিয়ে আমরা বরং ফিরে আসি ১লক্ষ বছর আগে। সেসময় হোমো সেপিয়েন্স দের সবচেয়ে কাছের প্রজাতি ছিল নিয়ান্ডারথাল’রা। এরা প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগে ইউরোপে মাইগ্রেশান করে এবং প্রায় ৪০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত সেখানে টিকে ছিল। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন এদের গড় উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি’র মতো। এদিকে পুরুষ হোমো সেপিয়েন্স দের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। এভাবে মানব প্রজাতির ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝা যায় কীভাবে সময়ের সাথে মানুষের উচ্চতা বাড়ছে। তবে গত ১০০ বছরে মানুষের গড় উচ্চতা বেড়েছে মাত্র ৪ সে.মি. এবং আমরা আমাদের উচ্চতার জেনেটিক লিমিটেশনের প্রায় চূড়ান্ত অবস্থায় আছি। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাহায্য ছাড়া মানবজাতির গড় উচ্চতাবৃদ্ধি তেমন বেশি হবে না।
আজকের আলোচনা এ পর্যন্তই। মানুষের আয়ু নিয়েও একইরকম গুজব বহুবার শোনা যায়। মানুষের আয়ু নিয়েও এরকম তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ খুব শীঘ্রই তিকতালিক আপনাদের সামনে নিয়ে আসবে। তিকতালিকের সাথে থাকুন।
A very detailed and well written article