সম্প্রতি ‘Queen Mary University of London’ এবং ‘The University of Bonn’ এর গবেষকদের সম্মিলিত গবেষণায় আমাদের স্তন্যপায়ী শ্রেণীর প্রাচীন সদস্যদের আয়ু নিয়ে এক আশ্চর্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আসলে “কৈ মাছের প্রাণ” ছিলো বলা যায়। অর্থাৎ এদের জীবনকাল ছিলো যথেষ্ট লম্বা। এখন এই তথ্যকে আশ্চর্যজনক বলে কেনো আখ্যায়িত করলাম? কারণ স্তন্যপায়ী শ্রেণীর উত্থানের সময় কিন্তু তারা খুব বেশি আকারে বড় কিছু ছিলো না। তাই চিন্তা করলে মনে হতে পারে, “ক্ষুদ্র তনুর মতোই ক্ষুদ্র জীবনকাল”। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবনকাল আজকের ক্ষুদ্র ইঁদুরের মতো ছিলোই না, তারা আকারে ছোট হলেও তাদের জীবনকাল ছিল বেশ দীর্ঘ। কয়েক মাস নয়, তারা বেঁচে থাকতো আট থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত। সম্ভবত, এই ছোট্ট প্রাণীরা তাদের জীবনের গল্পগুলো আরও দীর্ঘায়িত করে রাখার সুযোগ পেয়েছিলো কিছু রহস্যময় কোশলের মাদ্যমে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার এই রহস্যময় কৌশলগুলোই তাদেরকে সেই সময়ের পৃথিবীতে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।
জুরাসিক যুগ হলো মূলত আজ থেকে ২০ কোটি ১৩ লক্ষ বছর আগে থেকে ১৪ কোটি ৫৫ লক্ষ বছর আগে সময় পর্যন্ত সময়কাল। অপর নামে এটাকে অনেকেই মেসোজোয়িক মহাযুগের মধ্যপর্ব বলেন। প্রাণিজগতে এ সময়ে বেশ বড়সড় কিছু পরিবর্তন এসেছিলো, যার মধ্যে একটা হল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উত্থান। প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বেশিরভাগই ছোট তৃণভোজী বা কীটভুক ছিল। জুরাসিক যুগে সবথেকে বড় স্তন্যপায়ী ছিলো “রেপেনোম্যামাস” যার আকার প্রায় ১ মিটার এবং ভর ১২-১৪ কেজি।
যাহোক, উপরে উল্লিখিত গবেষণায় এই জুরাসিক স্তন্যপায়ী প্রাণী নিয়েই গবেষকেরা বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। গবেষণার জন্য পৃথিবীর তিনটি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে এসব প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম সংগ্রহ করা হয়, আর জীবাশ্মগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে কিছু পরীক্ষা করা হয়। এই বিশেষ পদ্ধতিটির নাম হচ্ছে “সিনক্রোট্রন এক্স-রে টমোগ্রাফি”, যেটায় ইলেকট্রনগুলোকে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি ত্বরান্বিত করা হয় (সাধারণ এক্স-রে ইমেজিংয়ের বিপরীতে)। যার ফলে জীবাশ্মগুলোকে কোনোরূপ কাঁটাছেড়া না করেই (অর্থাৎ কোনরকম স্লাইসিং বা অনুরূপ পরিবর্তন না করেই) সাধারণ এক্স-রে মাইক্রোটমোগ্রাফির চেয়ে উচ্চমানের চিত্র পাওয়া যায়।
গাছের গুড়ির মধ্যে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গোলাকার ও স্পষ্ট রিং-এর সাইজ দেখে যেমন বড় বড় গাছের বয়স প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা যায়, তেমনি জীবাশ্মগুলো থেকে প্রাপ্ত চোয়ালের টিস্যু বিশ্লেষণ করে তাদের জীবনাচার নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করেন গবেষকরা। চোয়ালের টিস্যুগুলোর মধ্যে কিছু ছোট ছোট রিং তাঁরা খুঁজে পান, যেগুলো দেখে চামড়ার চোখের দৃষ্টিতে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রিংগুলি গণনা করে, তাদের পুরুত্ব বিশ্লেষণের পাশাপাশি কিছু রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণা করে- এসব বিলুপ্ত প্রাণীর দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ে একটা সুস্পষ্ট ধারণা সামনে আসে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এদের বিপাকীয় হারের মধ্যে পরিবর্তন। মূলত এসময়ে দেখা যায়, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তুলনায় বেশি বজায় রাখার ফলে তাদের মৌল বিপাকীয় হার (BMR – Basal Metabolic Rate) সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের তুলনায় বেশি হয়। এই উচ্চ BMR শিশুদের দ্রুত কঙ্কাল বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়, যা প্রাপ্তবয়স্ক তথা যৌন পরিপক্বতা অর্জনের পর ধীরে ধীরে কমে যায়। এর প্রভাবই আমরা দেখতে পাই এদের আয়ুষ্কালের মধ্যে।
প্রাচীন এই স্তন্যপায়ীরা আদতে অনেক ধীরগতিতে বড় হতো। তাদের বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম হতে বছর গড়িয়ে যেতো যেখানে আজকের দিনের ইঁদুরের মতো প্রাণীগুলো কয়েক মাসেই বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রাচীন সেসব সদস্যরা আজকের ছোটো ছোটো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় অনেক দীর্ঘজীবী ছিলো। মোদ্দা কথা, এই গবেষণায় জীবাশ্ম হতে প্রাপ্ত টিস্যুর সিমেন্টোক্রোনোলজি এবং SRCT ইমেজিং ব্যবহার করে বৃদ্ধির প্যাটার্ন এবং শারীরবৃত্তীয় ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে, স্তন্যপায়ীদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ যারা পরিপূর্ণ স্তন্যপায়ী নয় এবং প্রাথমিক ক্রাউন স্তন্যপায়ী অর্থাৎ যারা পরিপূর্ণ স্তন্যপায়ী- এদের সাথে আধুনিক স্তন্যপায়ী প্রজাতির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আর এই পার্থক্যই তাদের জীবনকালকে করেছে দীর্ঘ।
আজকের গল্প এইটুকুই। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।
লেখিকা: ফাতিমা সাদ সুদীপ্তা, শিক্ষার্থী, BUET