প্রায় এক মিটার লম্বা স্তন্যপায়ীর সাথে জীবন-মরণ যুদ্ধে লিপ্ত তিন মিটার লম্বা এক ডাইনোসর। যুদ্ধের স্থান আজকের উত্তর চীন। এই মরণযুদ্ধ হয়েছিলো আসলে প্রায় সাড়ে বারো কোটি বছর পূর্বে, তখন এই স্থানে কোনো দেশ বা কোনো সভ্যতা ছিলোনা, ছিলো গভীর ঘন জঙ্গল। তৎকালীন ডাইনো সাম্রাজ্যে রাজগোষ্ঠীর কারোও সাথে এমন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সাধারণ খেটে খাওয়া স্তন্যপায়ী নিন্মশ্রেণীর জন্য ছিলো মৃত্যুসম। কিন্তু কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বিশাল থেকে বিশাল শক্তিকে যে পরাজিত করা যায় তার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি। নিজের থেকে প্রায় তিনগুণ বড় জন্তুটিকে হারিয়ে, হত্যা করে তাকে খাদ্যে পরিণত করে। কিন্তু খাওয়াটা অপূর্ণই রয়ে যায় তার।
খাদ্যগ্রাসের মাঝপথেই অগ্ন্যুৎপাতের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষের (লাহার- অগ্ন্যুৎপাতের ফলে হওয়া মাটির প্রবাহ) প্রবাহ এসে বয়ে যায় যুদ্ধস্থলে। ফলাফল, বিজয়ীরও মৃত্যু, বীরের মৃত্যু। লাহারে জমে শক্ত পাথরে পরিণত হয় তাদের দেহ। জমাট বাঁধার সময় স্তন্যপায়ী প্রাণীটির দাঁত আটকে যায় ডাইনোর বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে। সাড়ে বারো কোটি বছর পরে ২০১২ সালে এক কৃষক এই অসাধারণ ঐতিহাসিক গল্পের প্রত্যক্ষ দৃশ্য খুঁজে পান। এই জমাট বাঁধা পাথর তথা ডাইনো-স্তন্যপায়ীর অবশিষ্টাংশের ফসিল আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য আমাদের গর্বিত করে তোলে।
ডাইনো সাম্রাজ্যে স্তন্যপায়ীরা ছিলো ভীতু, কাপুরুষ- এমনটাই মনে করতেন জীবাশ্মবিদ, ভূতত্ত্ববিদ কিংবা বস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতো অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা। আগের সকল নিদর্শনে এটাই বোঝা যায়, একপাক্ষিক রাজত্ব ছিলো সরীসৃপ তথা ডাইনোদের। এই ফসিল সেই জনপ্রিয় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই ফসিল শুধু স্তন্যপায়ীদের লড়াই করার সাহসিকতার প্রমাণ এমন না, স্তন্যপায়ীরা যে কালেক্ষণে লড়াইতে জিততো তারও প্রমাণ এটি। এই ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে চীনের লিয়াওনিং প্রদেশ হতে, এই প্রদেশকে ‘ডাইনোসর পম্পেই’ ও বলা হয়। আগ্নেয়গিরির ধ্বংসযজ্ঞে হাজার হাজার প্রাণী জীবন্ত সৎকার হয়েছে এখানে।
যে দুই মহাশয়ের কথা এতক্ষণ আলাপ করছি তারা হলেন- সিট্যাকোসরাস এবং রেপেনোম্যামাস। রেপেনোম্যামাস সেইসময়ের সবথেকে বড় আকারের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একটি। এরা প্রচন্ড আক্রমণাত্মক। রেপেনোম্যামাস যে সিট্যাকোসরাসকে শিকার করেছিলো সেটা পূর্ণবয়স্ক ছিলো না। রেপেনোম্যামাসটির দাঁত ছিলো একদম সিট্যাকোসরাসের পিঞ্জরের ভিতরে, অর্থাৎ সিট্যাকোসরাসের মাংস-চামড়া ভেদ করে এই দাঁত ভিতরে গেঁথে গিয়েছে। আবার, রেপেনোম্যামাসের পিছনের পা সিট্যাকোসরাসের পায়ের নিচে চাপা পড়েছে যেখানে রেপেনোম্যামাসটি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এমনভাবে সিট্যাকোসরাসের চোয়াল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে রেখেছে যেনো চোয়াল টিপেই মেরে ফেলবে। এমন শারীরিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট বোঝা যায়, সিট্যাকোসরাস এবং রেপেনোম্যামাসের মধ্যে মরণযুদ্ধ হয়েছিলো, এবং রেপেনোম্যামাস এই যুদ্ধ জিতেছিলো। এমন নয় যে, সিট্যাকোসরাস অন্য কোনো কারণে আগেই মরে পড়েছিলো আর রেপেনোম্যামাস সুযোগ বুঝে তাকে ভক্ষণ করছিলো। যদিও এই ব্যাখার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যান্স লারসন। তার ভাষ্যমতে, স্তন্যপায়ী রেপেনোম্যামাসের এক হাত ডাইনোর মুখে ছিলো। এটা যদি লড়াই হতো তাহলে ডাইনোর এক কামড়েই স্তন্যপায়ীর হাত পুরো আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা, কারণ ডাইনোর বাইট ফোর্স অনেক বেশি। এমন হয়নি এর অর্থ ডাইনোসরটি আগে থেকেই মৃত হলেও হতক পারে। এর সম্ভাবনা একেবারে শূণ্য নয়।
অতীত ইতিহাসের এই গল্পে বিশেষজ্ঞরা এখন একটা বিষয় নিয়েই চিন্তিত, এই ফসিল আসল কিনা। উক্ত এলাকা আগে থেকে ফসিলের জন্য বিখ্যাত হয় আগে থেকেই দেখা গেছে, কেউ কেউ নকল ফসিল আসল বলে চালিয়ে নিজেকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে চলেছে। এজন্য, বিশেষজ্ঞরা এখনো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু রয়েছে কিনা। ফসিল আবিষ্কারের পরে এই ফসিল বিশেষজ্ঞদের হাতে এসে পৌছাতে অনেকদিন সময় লেগেছে যা তাদের মনে এরূপ সন্দেহ জাগ্রত করেছে। এখনো অবদি যতগুলি পরীক্ষণ চালানো হয়েছে এই ফসিলের উপর, এই ফসিল আসল এবং কোনোরকম ঠকানোর কাজ হচ্ছেনা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সামনে CT স্ক্যান সহ আরও কিছু পরীক্ষণ সম্পন্ন করা হবে সন্দেহ দূর করতে।
যদি এই ফসিল ভুয়া না হয়ে থাকে তবে জীবাশ্মবিদ্যায় এ এক অসাধারণ আবিষ্কার। মাত্র এক মিটার লম্বা এবং সাড়ে তিন কেজি ওজনের স্তন্যপায়ী, তিন মিটার লম্বা এবং প্রায় ১১ কেজি ভরের ডাইনোকে শিকার করছে- এমন হিসাব খুব বেশি বিরল না। অনেক মাংসাশী জন্তুই নিজের থেকে এমন তিন-চারগুণ অধিক বড় প্রাণীকে শিকার করে থাকে। কিন্তু সাড়ে বারো কোটি বছর আগেই ডাইনোদের রাজত্বে নিজেদের ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে যে স্তন্যপায়ীরা জানান দিতো তার প্রমাণ এই প্রথম! আসলে রাজা সবসময় রাজাই থাকে।
Reference: New Scientist, Amazing fossil hints mammals hunted dinosaurs three times their size