মানুষ সহ পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনের ভাষা কয়েকটা নির্দিষ্ট অক্ষরে লেখা। A (অ্যাডেনিন), G (গুয়ানোসিন), C (সাইটোসিন), T (থায়ামিন), U (ইউরাসিল)- এই পঞ্চপান্ডব মূলত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষার। এই ক্ষারগুলো পাঁচ-কার্বন বিশিষ্ট পেন্টোজ কার্বোহাইড্রেট তথা সুগারের সাথে মিলিত হয়ে তৈরী করে নিউক্লিওসাইড। উল্লেখ্য, ডিএনএ তৈরীতে যেসকল নিউক্লিওসাইড অংশগ্রহণ করে তাদের বেলায় ডিঅক্সিরাইবোজ স্যুগার এবং আরএনএ-র বেলায় রাইবোজ স্যুগার যুক্ত হয় ক্ষারের সাথে। এরপর এই নিউক্লিওসাইড যুক্ত হয় ফসফেট গ্রুপের সাথে, তৈরী হয় নিউক্লিওটাইড। নিউক্লিওটাইড পলিমার গঠনে সক্ষম একটি অণু। অসংখ্য নিউক্লিওটাইড পাশাপাশি শিকলের মতো যুক্ত হয়ে গঠিত হয় পলিনিউক্লিওটাইড তথা আমাদের জীবনকার্যের পরিচালক ডিএনএ বা আরএনএ।
আমরা আমাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যে জিন তথা অ্যালিলের কথা বলি তা আদতে কয়েকটা নিউক্লিওটাইড নিয়ে গঠিত পলিনিউক্লিওটাইড শেকলের ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া কিছু না। যাহোক, নিউক্লিওটাইডগুলোর কোনটা কোন বেস দিয়ে তৈরী তার উপর ভিত্তি করে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি এদেরকে। কেউ কেউ পিউরিন বেস নিউক্লিওটাইড (A,G বেস), কেউ কেউ পাইরিমিডিন বেস নিউক্লিওটাইড (C,T,U বেস)। এখনও নিউক্লিওটাইড শব্দটা খুব কঠিন লাগলে সহজ কথায় এরা প্রত্যেকে একেকটি রাসায়নিক যৌগ। আর জীবনের জন্য একেকটি অক্ষর। ডিএনএ এই চার অক্ষরে লেখা থাকে- অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C) এবং থায়ামিন (T) । অন্যদিকে আরএনএ এর গঠনও চারটা অক্ষরেই লেখা, শুধু থায়ামিনের পরিবর্তে ইউরাসিল (U) উপস্থিত। এবার আসল রহস্যে ঢোকা যাক। ভাবুন, পৃথিবীর তাবৎ জীবের মধ্যে, ভাইরাসের মধ্যে আপনি এই কয়েকটা অক্ষরে লেখা ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন। হঠাৎ একদিন ঘটলো বিপত্তি।
কেউ যদি আপনার সামনে এসে এখন Apple বানান লিখে Zpple , তো কেমন লাগবে? উইয়ার্ড? তেমনই কিছুর সন্মুখীন হন গবেষকরা ১৯৭৭ সালে। তারা একটি সায়ানোফাজ ভাইরাসের জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখেন তাদের জিনোম সিকোয়েন্সে Apple এর জায়গায় Zpple লেখা। অর্থাৎ তাদের জিনোমে A এর পরিবর্তে Z উপস্থিত। তো সহজ কথায় নতুন এক টাইপের নিউক্লিওটাইডের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা, Z এর গঠন অ্যাডিনিন থেকে আলাদা। Z নিউক্লিওটাইডের নামকরণ করলে কিছুটা এমন: ২-অ্যামিনোঅ্যডিনিন। এটি একটি পিউরিন বেস নিউক্লিওটাইড।
জিনোম সিকোয়েন্সে এই নিউক্লিওটাইডের উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের কপালে ছোটোখাটো চিন্তার দাগ হয়ে ছিলো কয়েকদশক। এ নিয়ে গবেষণা আরও চলতে থাকে। ৩০ এপ্রিল ২০২১ এ একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় Z নিউক্লিওটাইড নিয়ে। ফ্রান্স ও চীনের তিনটা পৃথক রিসার্চ টিমের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয় সেখানে।
PurZ এবং PurB নামক দুইটা প্রোটিন এই Z নিউক্লিওটাইড তৈরী করে। আগেই বলেছি, প্রথম Z নিউক্লিওটাইড শনাক্ত করা হয়েছিলো সায়ানোফাজ ভাইরাসে। তো সায়ানোফাজ একধরনের ব্যাক্টেরিফেজ ভাইরাস। ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাস তারা যারা ব্যাক্টেরিয়ার শরীরে প্রবেশ করে, নিজের ডিএনএ কে ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ-র সাহায্যে রেপ্লিকেট করে নিজের বংশবিস্তার করে। সায়ানোফাজ ভাইরাস এই কাজে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করে। তো ব্যাক্টেরিয়ার দেহে ভাইরাসের ডিএনএ-র যখন রেপ্লিকেশন শুরু হয় তখন ঐ PurZ এবং PurB প্রোটিন দুইটা প্রিকার্সার Z মলিকিউল সিন্থেসিস করে মানে তৈরী করে এবং এই মলিকিউলটাকেই Z নিউক্লিওটাইডে রূপান্তরিত করে। বেশ কয়েক ধাপে এই ট্রান্সফরমেশন ঘটে। এরপর অন্যান্য প্রোটিন এই নিউক্লিওটাইডকে মডিফাই করে ভাইরাল ডিএনএ-র সাথে সংযুক্ত হওয়ার উপযোগী করে। DpoZ নামে এক প্রকার ডিএনএ-পলিমারেজ এনজাইম আছে। রেপ্লিকেশনের সময় ঠিক নতুন ডিএনএ’র যেখানে যেখানে A নিউক্লিওটাইড হওয়ার কথা ঠিক সেখানে সেখানে Z নিউক্লিওটাইড বসায়ে দেয়। আগে মনে করা হতো জিনোমে Z নিউক্লিওটাইড খুবই দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে মোটামুটি ২০০ টির বেশি ব্যাক্টেরিফাজ ভাইরাসে এই নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে।
এই জিনোমের বেশ কিছু সুবিধা এবং সম্ভাবনার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৮০ সালেই দেখা যায় উচ্চ তাপমাত্রায় অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় Z নিউক্লিওটাইড আছে এমন ভাইরাস বেশি স্টাবল। ফলে ধারণা করা হচ্ছে বহু বছর আগে উত্তপ্ত গরম পৃথিবীতে ভাইরাসের টিকে থাকতে এই জিনোম কিছুটা সুবিধা দিয়েছিলো। ব্যাক্টেরিওফাজ ভাইরাসের ডিএনএ যখন ব্যাক্টেরিয়ার দেহে প্রবেশ করে তখন কিছু প্রোটিন এটাকে ধ্বংসের চেষ্টা করে, ব্যাক্টেরিয়ার আত্মরক্ষার জন্য, সেই প্রোটিনগুলোকে Z নিউক্লিওটাইডবিশিষ্ট ভাইরাল ডিএনএ সহজে প্রতিরোধ করতে পারে। আবার এই নিউক্লিওটাইড ডিএনএ সূত্রকদ্বয়ের একটির সাথে আরেকটির সংযোগ অ্যাকুরেট হতেও সহায়তা করে। Z নিউক্লিওটাইড সমৃদ্ধ ডিএনএ বেশি স্টাবল হয় তার কারণ হাইড্রোজেন বন্ড। সাধারণ ডিএনএ তে A ও T দুইটি হাইড্রোজেন বন্ড এবং G ও C তিনটি হাইড্রোজেন বন্ডে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু A এর জায়গায় Z নিউক্লিওটাইড থাকলে T এর সাথে তিনটা হাইড্রোজেন বন্ডে যুক্ত হয়। ফলে ডিএনএ বেশি স্টাবল হয়। এটা খুব উত্তপ্ত, প্রতিকূল পরিবেশে ডিএনএ কে টিকে থাকতে সুবিধা দিয়েছে। ভাইরাস ছাড়া তুলনামূলক উন্নত প্রজাতিতে এই নিউক্লিওটাইডের সহজে দেখা মিলছে না তার কারণ এটা বর্তমান পরিবেশের জন্য ফ্লেক্সিবল না। ডিএনএকে প্রতিমুহূর্তে রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশনের মতো প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যার জন্য আবার নরমাল ডিএনএ (A অক্ষরের) বেশি উপযোগী। এজন্য প্রাণের শুরুতে Z নিউক্লিওটাইডের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও আজকের উন্নত প্রজাতিগুলোতে এই নিউক্লিওটাইড খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। তবে কিছু ট্রেস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এবার আসি এই Z নিউক্লিওটাইডের বিবর্তনের ইতিহাসে। অ্যানালাইসিস থেকে জানা যায় PurZ নামক প্রোটিনটির উৎপত্তি শতাব্দী প্রাচীন আর্কেয়িদের PurA প্রোটিন থেকে। PurZ এর বিবর্তনীয় ইতিহাস জানার পর প্রশ্ন উঠে-
Z নিউক্লিওটাইড তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন কী ব্যাক্টেরিয়ার দেহে উৎপন্ন হয়েছিলো যার ফলে পরবর্তীতে ভাইরাসে Z নিউক্লিওটাইডের সৃষ্টি হয় এবং এটা অভিযোজিত হয়ে টিকে যায়? নাকী শুরুর দিকের প্রাণগুলোতে এই ঘটনা অহরহ ছিলো? দেখা গেছে PurZ প্রোটিন এবং DpoZ প্রোটিন প্রায়শঃই একইসাথে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হচ্ছে। এর অর্থ Z জিনোমও খুব সম্ভবত সেই ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীর প্রাণের মাঝেও অস্তিত্বমান ছিলো। এর সাথে আরেকটা সম্ভাবনা উঠে আসে ১৯৬৯ সালে এন্টার্কটিকায় হওয়া উল্কাপাতের ঘটনা থেকে। ঐ উল্কাপাত থেকে Z নিউক্লিওটাইড সহ কিছু স্টান্ডার্ড, ননস্টান্ডার্ড নিউক্লিওটাইড পাওয়া গেছে যা Z নিউক্লিওটাইডের পৃথিবীর বাইরে থেকে আসার একটা সম্ভাবনাও তুলে ধরে। যাহোক, এত এত সম্ভাবনার গল্প এই গনেষণায় অংশ নেওয়া একজন অভিজ্ঞ গবেষকের উক্তি তুলে ধরে শেষ করি।
“The phages Carrying this Z-genome could be considered as a different form of life”
Reference:
1) livescience, phages virus z genome more widespread than thought
2) science sciencemag, content/372/6541/516