“That essentially every atom in your body was once inside a star that exploded. Moreover, the atoms in your left hand probably come from a different star than those in your right. We are all, literally, star children, and our bodies are stardust.”
Lawrence Krauss
আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান। এই একটি উক্তিই যথেষ্ট এই মহাবিশ্বের ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার জন্য। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী সৌরজগতের একটি অংশ। এই সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে এর নক্ষত্র- সূর্য। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, আমাদের আলো দিচ্ছে, তাপ দিচ্ছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল রাসায়নিক শক্তির জোগানও দিচ্ছে। আমাদের সূর্য এই মহাবিশ্বের একমাত্র নক্ষত্র না। আমরা আসলে রাতের আকাশে যত তারা দেখি, সেগুলো সবই বিজ্ঞানের ভাষায় নক্ষত্র। শুধু আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যাল্যাক্সিতেই ১০০-৪০০ বিলিয়ন এমন নক্ষত্র রয়েছে। এসব নক্ষত্রের জন্ম রয়েছে, মৃত্যুও রয়েছে। এসব নক্ষত্রের মৃত্যু থেকেই আমরা পেয়েছি আমাদের জীবনের কাব্যিক অনুরণন।
আমরা যেমন ভ্রূণাবস্থা, বাল্যকাল, কিশোরকাল, যৌবনকাল, বৃদ্ধকাল অতিক্রম করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই, নক্ষত্ররাও তেমন। আবার সব নক্ষত্রের জীবনের শেষ পরিণতি একরকম হয় না। কেউ কেউ শ্বেত বামনের রুপে, কেউ নিউট্রন তারকা আবার কেউ ব্লাকহোল রুপে নিজেদের জীবন শেষ করে। কোন নক্ষত্র কীভাবে জীবদ্দশার অবসান ঘটাবে, তার জীবনকাল কতটুকুই বা লম্বা হবে তা মূলত নির্ভর করে ঐ নক্ষত্রের ভরের উপরে। আর এর মাপকাঠি হিসেবে আমরা ব্যবহার করি আমাদের সূর্য। কোন নক্ষত্রের প্রাথমিক ভর সূর্যের ভরের ঠিক কতগুণ তা হিসাব করেই মোটামুটি অন্য নক্ষত্রের সব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়।
জ্বালানী বেশি হলে গাড়ি বেশিদূর চলবে- এই নিয়ম নক্ষত্রের ক্ষেত্রে খাটে না। বেশি ভরের নক্ষত্র গুলোয় ফিউশন খুব দ্রুত ঘটে। ফলে জ্বালানী তাড়াতাড়ি শেষ হয়। নক্ষত্র তুলনমুলক বেশি উজ্জ্বল হয়।
নক্ষত্রের ভর যত কম হয় ফিউশন তত আস্তে ঘটে, জ্বালানী ধীরে ধীরে শেষ হয়, নক্ষত্র তুলনামূলক কম উজ্জ্বল হয়। ভর কম হলে এদের অন্তমুর্খী টান (মহাকর্ষ বল) কম হয়, যার ফলে সাম্যাবস্থা বজায় রাখার জন্য বহির্মুখী বল (ফিউশনে উৎপন্ন) কম প্রয়োজন। তাই ফিউশন ঘটেও ধীরে। ভর বেশি হলে একই কারণে ফিউশন দ্রুত ঘটে।
আজ আলোচনার মূল বিষয় নক্ষত্রের জন্ম। এই প্রবন্ধে যতদূর সম্ভব সবকিছুর খুঁটিনাটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। কিছু কিছু শ্রেণিবিভাগ ইচ্ছা করে ব্যাখা করিনি, তাহলে হয়তো পাঠক শেষ পর্যন্ত পড়ার মানসিকতা ধরে রাখতে পারতো না। যা-হোক, আর ভূমিকা না বাড়িয়ে, নক্ষত্রের জন্মগাঁথা শুরু করা যাক।
নেবুলা- নক্ষত্রের আঁতুরঘর

নেবুলা কোনো নক্ষত্রের জন্মের একদম আদিমতম বা প্রাথমিক ধাপ। নেবুলা মূলত কি? nebulae একটি ল্যাটিন শব্দ যার বাংলা অর্থ হলো মেঘ। নেবুলা মূলত বৃহদাকার মহাজাগতিক মেঘ। এই মেঘ ধূলাবালি আর গ্যাসের মেঘ। স্থানভেদে এই মেঘে কিছু পার্থক্য থাকে। এই মেঘ হতে পারে ইন্টারগ্যালাক্টিক-ডাস্ট, ইন্টারস্টেলার-ডাস্ট। নেবুলার মূল উপাদান যদি হিসাব করি তবে, সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ধূলা যেখানে লোহা, নিকেল, ম্যাগনেশিয়াম, গ্রাফাইট, ডায়ামন্ড প্রভৃতি কঠিন পদার্থও থাকে। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগের অণু যেমন কার্বন মনোক্সাইড, অ্যাসিটোন, মিথানল প্রভৃতির উপস্থিতিও পাওয়া যায়। এর সিংহভাগ গ্যাস হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম। এছাড়াও অতি অল্প মাত্রায় কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন থাকে। নেবুলা মহাকাশের সবথেকে বৃহত্তর বস্তুর মধ্যে একটি। কয়েক আলোকবর্ষ জায়গা জুড়ে একটি মহাজাগতিক মেঘ ছড়িয়ে থাকতে পারে। কোনো কোনো মেঘ আবার এক আলোকবর্ষ জায়গাও দখল করেনা।
নেবুলার প্রকারভেদ:
১) ডিফিউজ নেবুলা: এই ধরণের নেবুলা দীর্ঘ পরিসরে জায়গা দখল করে, এর কোনো সুচিহ্নিত সীমারেখা থাকেনা। এজন্য এর এমন নামকরণ করা হয়েছে। এই ধরনের নেবুলাকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয়।
ক) রিফ্লেকশন নেবুলা: প্রতিফলক নেবুলা। এর অর্থ অন্য কোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলো এর দ্বারা প্রতিফলিত হয়। ফলে আমরা এই নক্ষত্রগুলোকে শনাক্ত করতে পারি। এক্ষেত্রে আশেপাশে থাকা নক্ষত্র সমূহের শক্তি অনেক কম হয় যার ফলে এরা নেবুলার পরমাণুসমুহকে আয়নিত করতে পারে না।
খ) এমিশন নেবুলা: এমিশন অর্থ বিকিরণ। এক্ষেত্রে একটা নেবুলার আশেপাশে থাকা এক বা একাধিক উত্তপ্ত নক্ষত্র হতে আল্ট্রাভায়োলেট (অতিবেগুনী) রশ্মি নির্গত হয়। নেবুলায় উপস্থিত পরমাণু এই রশ্মি শোষণ করে, আয়নিত হয়, ফলে পরমাণুতে উপস্থিত ইলেক্ট্রনসমূহ শক্তি পেয়ে নিম্ন শক্তিস্তর হতে উচ্চ শক্তিস্তরে পৌছায়। পরবর্তীতে আয়োনিত পরমাণুর ইলেক্ট্রনসমূহ যখন যখন পুনরায় তারা উচ্চ শক্তিস্তর হতে নিন্ম শক্তিস্তরে নেমে আসে তখন শক্তি বিকিরণ করে। এই শক্তি আমাদের দৃশ্যমান আলোরূপে নির্গত হয় (বামার সিরিজ তৈরী হয়)।
এই ধরণের নেবুলার রং সাধারণত আমরা লাল দেখি৷ কারণ, নেবুলায় অবস্থিত হাইড্রোজেন পরমাণুই প্রধানত শক্তি শোষণ করে আয়নিত হয় এবং পরবর্তীতে বামার সিরিজ তৈরী করে। কিন্তু কিছু কিছু নেবুলার রং সবুজ এবং নীল রংয়ের হয়। এক্ষেত্রে আশেপাশের শক্তির উৎস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়, ফলে তারা হাইড্রোজেনের সাথে সাথে অন্যান্য পরমাণু (হিলিয়াম, অক্সিজেন) কেও উত্তপ্ত করে। নেবুলা থেকে প্রাপ্ত বিকিরণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করেই আমরা নেবুলার উপাদানসমূহ জানতে পারি।
২) ডার্ক নেবুলা: এই ধরনের নেবুলার আশেপাশে নক্ষত্র সংখ্যা তুলনামুলক কম থাকে। একটা – দুইটা যাও নক্ষত্র থাকে তার আলো এই নেবুলার ঘনত্ব ভেদ করে আমাদের কাছে পৌছায় না। এমন নয় শুধু নক্ষত্র, অনেক সময় এমন নেবুলা ইমিশন নেবুলা থেকে আসা আলো আটকে দেয়, এতে নানারকম রাসায়নিক উপাদাব থাকে যা আলো শোষণ করে নেয় সব আলো। এজন্য, একে absorption নেবুলাও বলে। মোট কথা, যে কোন উৎস থেকে আসা আলোই এতে বাঁধা পায়, একে পেরিয়ে আসতে পারেনা। আবার এমন কোনো শক্তিশালী উৎসও এর আাশেপাশে থাকেনা যা এর পরমাণুকে আয়নিত করার মত শক্তি দিতে পারে।
৩) প্লানেটারি নেবুলা: নামের সাথে কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ এই ধরনের নেবুলার সাথে প্লানেটের কোনো সম্পর্কই নাই। এই ধরনের নেবুলা হলো উদ্দীপ্ত গ্যাসের খোলক (Shell of gas). অপেক্ষাকৃত ছোট নক্ষত্রের রেড জায়ান্ট দশা শেষ হলে গ্যাসের এই শেল তৈরী হয় যা কয়েকহাজার বছর পর্যন্ত এমনই থাকে, অন্য কোনো নেবুলার অংশ যদি না হয় তবে এই গ্যাস ধীরে ধীরে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়। এই ধরনের নেবুলা তুলনামুলক আকারে ছোট, মাত্র এক আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধ (এটা মাত্র)।
স্পাইরাল গ্যালাক্সির বাহুর ভাঁজে কিংবা দুইটা অতিকায় নক্ষত্রের মাঝে, দুই গ্যালাক্সির মাঝে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অন্য নক্ষত্রের মৃত্যুর মাধ্যমে সৃষ্ট বিভিন্ন ভারী পদার্থ, গ্যাস জমা হয়ে এই মেঘ তৈরী হয়। এই মেঘের অণু-পরমাণুগুলোর মধ্যে মধ্যাকর্ষণ বল কাজ করে। এই বল অণুপরমাণুগুলোকে কাছাকাছি টানে, সংকুচিত করে ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনা করা যায়:
→ ভর-ঘনত্বের ভারসম্যহীনতা: শিরোনাম পড়ে যতটা কঠিন বিষয় মনে হচ্ছে এটা ঠিক ততটাই সহজ। কয়েক আলোকবর্ষ জুড়ে একটা ধুলার মেঘ অবস্থিত। কখনোই এই মেঘের সবখানে সমান ঘনত্বের উপাদান থাকবে না। জায়গায় জায়গায় ঘনত্ব কম বেশি হবে। যেখানে ঘনত্ব বেশি সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মহাকর্ষ বলের প্রভাবও বেশি হবে। এই মহাকর্ষ বল কেন্দ্র মুখী- অন্তর্মুখী টান। কিন্তু এই চাপের বিপরীতে এখনো কোনো বহির্মুখী চাপ তৈরী হয় নি। ফলে ঘনত্ব আরও বাড়তে থাকবে৷ এই অধিক মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উপাদানও জড়ো হয়। স্বল্প আয়তনে অনেক বেশি ভর- এরপর শুরু হয় ঘনীভবন প্রক্রিয়া। এই ঘন এলাকাগুলি আরো বিশাল ঘনীভূত মেঘে পরিণত হয়। এটাই নক্ষত্র গঠনের শুরু।
→ শক ওয়েব: অনেকে মনে করেন, নেবুলার আশেপাশে হওয়া সুপারনোভা বিস্ফোরণ স্পেসটাইম চাদরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই আলোড়নের ফলে নেবুলার মাঝে কিছু এলাকায় উপাদানের ঘনত্ব বেড়ে যায় আর কিছু জায়গায় কমে যায়।
নক্ষত্র গঠনের পূর্বে নেবুলার তাপমাত্রা সাধারনত খুবই কম থাকে। ফলে এসময় নানাধরণে রাসায়নিক অণু সেখানে গঠিত হয়ে থাকে। পোষ্টের প্রথমে উল্লেখিত কার্বন মনোক্সাইড, অ্যাসিটোন, মিথানল প্রভৃতি যৌগের অনু এর উদাহরণ। এই অণু গঠন প্রক্রিয়া নেবুলার ঘন অঞ্চল গুলোতেই ঘটে। একটা নেবুলায় ধরুন এরকম ঘন ১০০ টি এলাকা তৈরী হলো। এই ১০০ টি এলাকা হতেই নতুন নক্ষত্র সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ একটি নেবুলা শুধু একটিই অতিকায় নক্ষত্র জন্ম দিবে এমন নয়।
গ্রেভিউলস- নক্ষত্রের ভ্রূণ

এবার নেবুলার পরবর্তী অবস্থা দেখা যাক। আসলে গ্লোবিউলস নিয়ে এক প্রকার আলোচনা করেই ফেলেছি। ঐ যে, নেবুলায় কিছু অতি ঘন অঞ্চল তৈরী হলো, আশেপাশের এলাকা থেকে আরও অণু এসে জড়ো হলো, স্বল্প এলাকায় অতিকায় ভর। একটু সাহিত্য দিয়ে বললে, এই ঠান্ডা, অতি ঘন গ্যাস এবং ধূলিকণা নিয়ে যে জমাট বাঁধা মহাজাগতিক মেঘ তাই গ্লোবিউলস। এই গ্লোবিউলের ব্যাসার্ধ সাধারণত ১ আলোক বর্ষ বা তার বেশি হয়। আর ভর হয় ২-৫০ টা সূর্যের ভরের সমান। এর বেশিও হতে পারে। তবে বেশিরভাগ গ্লোবিউলের ভর ১০০ সূর্য ভর থেকে কমই হয়।
একটা বিষয় ক্লিয়ার করেছি। একটা নেবুলায় এমন অতি ঘন একাধিক অঞ্চল থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্লোবিউল গুলো ডবল স্টার সিস্টেম বা মাল্টি স্টার সিস্টেম গঠন করে। কারণ, একই নেবুলায় পাশাপাশি একাধিক গ্লোবিউল থাকে যা থেকে পরবর্তীতে নক্ষত্রের জন্ম হয়। এই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে যে মহাকর্ষ বলের বন্ধন থাকে তা ছিন্ন হয় না।
যা হোক। এই গ্লোবিউল “holes in heaven”, অনুবাদ হিসেবে বলা যায় “স্বর্গের কুয়া” নামে পরিচিত ছিল। আসলে এরা অতি ঘন, এরা কোনো নক্ষত্রের সামনে থাকলে সেখান থেকে আলো – এই ঘন এলাকা ভেদ করে আসতে পারে না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটা কোনো কুয়া/গর্ত।
এই গ্লোবিউলের ভিতরে এবার উষ্ণ কোর সৃষ্টি হয়। আসলে এটা হয় শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি মেনে। প্রথমে সকল অণু পরমাণু গতিশীল অবস্থায় ছিলো। তারপর মহাকর্ষ বলের টানে কাছাকাছি এসেছে। অণু-পরমাণু সমূহের মধ্যে মুক্তপথ কমেছে। স্বল্প জায়গায় অণু-পরমাণু সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সংঘর্ষ বেড়েছে। সংঘর্ষের ফলে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়েছে। কয়েক বিলিয়ন পরমাণুতে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক বিলিয়ন সংঘর্ষ হলে ঠিক কি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হবে তা বোঝানো সম্ভব নয়। অণু পরমাণুর যত সংঘর্ষ হয়েছে, এদের গতিশক্তি কমেছে, বেগ কমেছে। সেই হারিয়ে গতিশক্তি এই তাপশক্তির জোগান দিছে।
সব গ্লোবিউলে উত্তপ্ত কোর থাকেনা। যথেষ্ট তাপশক্তি উৎপন্ন না হওয়ার কারণে। উত্তপ্ত কোর বিশিষ্ট যে গ্লোবিউল, এ থেকেই জন্ম নিবে নতুন শিশু নক্ষত্র প্রোটোস্টার।
প্রোটোস্টার-সদ্যজাত শিশু নক্ষত্র

অভিকর্ষের প্রভাবে সংকুচিত, অতি ঘনত্বের উত্তপ্ত পিণ্ড হলো প্রোটোস্টার। এর তাপমাত্রা ২০০০ থেকে ৩০০০ কেলভিন হয়। এটি যথেষ্ট উত্তাপ প্রোটোস্টার থেকে শনাক্তযোগ্য তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের জন্য। প্রোটোস্টারের কোর হতে প্রচুর অবলোহিত রশ্মি নির্গত হয়। মূলত এ থেকে দৃশ্যমান আলোও নির্গত হয়, কিন্তু এর চারপাশ ঘিরে প্রচুর ধূলা, গ্যাসের স্তর থাকে। যার ফলে আমাদের কাছে দৃশ্যমান আলো পোছায় না। আমরা প্রোটোস্টার চিহ্নিত করি এই অবলোহিত রশ্মি শনাক্ত করে। আবার প্রোটোস্টারের আশেপাশে থাকা ধূলিকণা সামান্য উত্তপ্ত হয় প্রোটোস্টারের তাপে, এসব ধূলা হতে মাইক্রোয়েভ রশ্মি নিঃসৃত হয় যা শনাক্তযোগ্য।
সদ্যজাত এই নক্ষত্রে অণু পরমাণুর ঘনত্ব অনেক বেশি থাকায় এর মধ্যে এক ধরনের বহির্মুখী চাপের সৃষ্টি হয়। বিষয়টা আপনিও অনুধাবন করতে পারেন। একটা ফুলানো বেলুনে চাপ দিন। বেলুন কিছুটা খালি থাকলে বাইরে থেকে দেওয়া চাপ নিউট্রলাইজ করতে ভিতরে থাকা গ্যাসের অণু সেই ফাঁকা জায়গা দখল করবে, বেলুনের আয়তন কমিয়ে। এরপর আরো বেশি চাপ দিলে আপনি বহির্মুখী একটা বাঁধা অনুভব করবেন।
মেঘ সংকুচিত হয়ে যখন প্রোটোস্টার তৈরী হয়, তখন এর ঘূর্ণন বেড়ে যায়। মেঘে থাকা ধূলিকণা, গ্যাসের অণু গতিশীল থাকে, এটা আগে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ বিশাল এই মেঘ থাকে উচ্ছৃঙ্খল (turbulent), এর কৌণিক ভরবেগও থাকে। এইসব অণু-পরমাণু যখন একে অপরের উপর আছড়ে পড়ে, মহাজাগতিক মেঘ সঙ্কুচিত হয় এর নিজের গ্রাভিটির টানে, তখন এই মেঘের বিস্তার পরিবর্তিত হয়, কমে যায়। ফলে এই মেঘের বিশালতার ব্যাসার্ধও কমে যায়। আমরা কি জানি কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষিত থাকে? কোনো কিছুর ব্যাসার্ধ যত কমে তত এর কৌণিক বেগ বৃদ্ধি পায়। তাই নতুন সৃষ্ট প্রোটোস্টারের ঘূর্ণন বেশি থাকে। যেকোনো ঘূর্ণনরত বস্তুর ক্ষেত্রে কৌণিক ভরবেগ L হলে, L=mvr. রৈখিক বেগ v যদি কমও হয় তবু ভর m আর ব্যাসার্ধ r এর বিশাল বড় মানের জন্য প্রোটোস্টারের কৌণিক ভরবেগ অনেক বেশি হবে।
প্রোটোস্টারের এই ঘূর্ণনের জন্য এতে এক ধরনের ম্যাগনেটিক প্রেসার তৈরী হয় যেটা বহির্মুখী কাজ করে। তাহলে আমরা দুই ধরনের বহির্মুখী বলের ব্যাপারে জানলাম যেটা প্রোটোস্টারের সংকোচন তথা এর অভিকর্ষ টানের বিপক্ষে কাজ করে। ফলে প্রোটোস্টারের সংকোচন থেমে যায়। কিন্তু মহাজাগতিক মেঘ থেকে তখনও ধূলিকণা, গ্যাস প্রোটোস্টারে আসছে, এর ভর বাড়ছে, অভিকর্ষের টান বাড়ছে। সংকোচন চাপ বাড়ছে যা বহির্মুখী চাপকে অতিক্রম করে যাবে। শুরু হবে আবার সংকুচিত হওয়ার পালা। এসব বলার আগে আরও কিছু টুকরো টুকরো বিষয়ে কথা বলে নিই।
H II অঞ্চল: এটার মূলকথা আগে বলেছি, এমিশন নেবুলার বিবরণে। একটা বিরাট আকৃতির নেবুলা থেকে একটা প্রোটোস্টার তৈরী হলো। এই প্রোটোস্টারের তাপ, অতিবেগুনী রশ্মি এর আশেপাশের মেঘের ধূলিকণাকে উত্তপৃত করে, গ্যাসকে আয়োনাইজ করে। H I বলতে মুলত হাইড্রোজের পরনাণুকে বোঝায় আর HII বলতে আয়নিত হাইড্রোজেন গ্যাস। এই আয়নিত গ্যাসের দরুণ কি হয় না হয় তা এমিশন নেবুলা অংশে বিস্তারিত আলেচনা করেছি।
আমরা দেখলাম প্রোটোস্টারের অন্তর্মুখী টান আবার এর বহির্মুখী চাপকে টেক্কা দিয়ে একে সংকুচিত করা শুরু করেছে। আসলে এই সংকোচন শুরুর পূর্বে প্রোটোস্টারের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল অনেক বেশি থাকে, যার ফলে এর উজ্জ্বলতাও অনেক বেশি। যত কম ভরের প্রোটোস্টার, তত বেশিদিন এর উজ্জ্বলতা। যত বেশি ভরের প্রোটোস্টার, এর সংকোচনও তত তাড়াতাড়ি শুরু হয়, উজ্জ্বলতাও তাড়াতাড়ি কমে। তবে কোনো নক্ষত্র এই প্রোটোস্টার পর্যায়ে কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত থাকে।
টি টরি দশা- প্রোটোস্টার ডিস্ক

শুরুটা হয়েছে নক্ষত্রের কৌণিক ভরবেগের জন্য। আশেপাশে মহাজাগতিক মেঘ, মাঝে সদ্য সৃষ্ট প্রোটোস্টার- মেঘের উত্তপ্ত পিন্ড ভণ ভণ করে ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের ফলে গ্যাসের মেঘ কিছুটা ফ্লাট হতে শুরু করে, ফ্লাট আর্থের মতোই কল্পনা করুন বা পিজ্জার মতো। ঘূর্ণনের ফলে প্রোটোস্টারের বাইরের দিকে থাকা মেঘের আস্তরণে কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয়, এই কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করে ব্যাসার্ধ বরাবর বাইরের দিকে, গ্রাভিটির বিপরীতে। এর ফলে যে ব্যাসার্ধ বরাবর এই বল কাজ করে, সেই দিকে মেঘের বিস্তরণ ঘটে আর ব্যাসার্ধের উলম্ব বরাবর থাকা ধূলা-গ্যাস কেন্দ্রের দিকে আর সংকুচিত হয়ে আসে। ফলে আস্তে আস্তে একটা বিশাল বড় ডোমিনোজ ফ্যামিলি পিজ্জা তৈরী হয় যার কেন্দ্রে উত্তপ্ত প্রোটোস্টার। যে দিকে মেঘের বিস্তরণ ঘটছে তার উলম্ব দিকে তখন বাইরে থেকে ধূলা-বালি আসতে থাকে। আসলে সে দিকে তো আর এই কেন্দ্রবিমুখী বাঁধা নেই। তবে কিছুটা গ্যাসের চাপ আছে।
ফলে উলম্ব বরাবর একটা পাতলা ডিস্ক উৎপন্ব হয়। তৈরী হলো একটি আদর্শ টি-টরি পর্যায়ের নক্ষত্র। টরাস নক্ষত্রপুঞ্জের প্রোটোস্টারের নামে এই নামকরণ।
এই প্রোটোস্টেলার ডিস্ক হতে গ্রহ, ধুমকেতু প্রভৃতি সেলেস্টিয়াল বস্তু তৈরী হয়। যা-হোক, এরপর প্রোটোস্টারের অক্ষদন্ড বরাবর ঝড় সৃষ্টি হয়। প্রচন্ড এই বায়ুঝড় (stellar wind) প্রোটোস্টারের আশেপাশের ধূলা ও গ্যাস অনেকখানি অপসারণ করে। ফলে মহাজগতে প্রোটোস্টারের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
এরপর এর কোরে শুরু হয় ফিউশন। মূল ফাংশন। একটা মূলধারা নক্ষত্রের সব শক্তি আসে এই ফিউশন প্রক্রিয়ায়। ফিউশন শুরু হওয়ার মাধ্যমেই নক্ষত্রের প্রাণসঞ্চার ঘটে। কিন্তু সব কিছু হলো, একটা নক্ষত্র যেভাবে তৈরী হয় তার সব নিয়ম মেনে আসলো। মহাজাগতিক মেঘ সংকুচিত হয়ে গ্যাস, ধূলিকণার নক্ষত্রসদৃশ গঠনও সৃষ্টি হলো। কিন্তু এতে ফিউশন শুরু হলো না? কি হবে তাহলে?
বাদামী বামণ (brown dwarf): এই টাইপের বস্তু বৃহস্পতি গ্রহ থেকে ৭৫-৮০ গুণ ভারী হয়। এরা নক্ষত্র হতে হতেও থেকে যায় এদের ঘনত্বের কারণে। এদের ঘনত্ব তুলনামূলক কম হওয়ায় এদের কোরে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম ফিউশন শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী না। কেউ কেউ মনে করেন ব্রাউন ডোয়ার্ফে ফিউশনের মাধ্যমে ডিউটেরিয়াম (কম ভরের ডোয়ার্ফ) আর লিথিয়াম (বেশি ভরের ডোয়ার্ফ) তৈরী হয়। তবে খুব স্বল্প পরিমাণে ঘটে এই ফিউশন। তাহলে ব্রাউন ডোয়ার্ফের বিষয়টা বোঝা গেলো। কোনো কোনো ব্রাউন ডোয়ার্ফের চারপাশে গ্রহ থাকে, আমাদের এই সৌরজগতের মতোই। আমরা কিন্তু এই ডোয়ার্ফগুলো শনাক্ত করতে পারি। এদের কোর উত্তপ্ত, উপরে বলেছি কি ধরনের ফিউশন এতে ঘটতে পারে, এমন না ঘটলেও প্রোটোস্টার পর্যায়ে এদের কোর উত্তপ্ত হয়ই। যার ফলে এ থেকে দৃশ্যমান আলো নিঃসৃত হয়, এরা বেশ উদ্দীপ্ত থাকে।
মূল ধারার নক্ষত্র

যেসকল প্রোটোস্টারের ঘনত্ব যথেষ্ট থাকে তাদের কোরে ফিউশন শুরু হয়। তাদের মধ্যে হাইড্রোস্টাটিক ভারসম্য রক্ষা হয় এই ফিউশনের ফলে। ফিউশনের ফলে সৃষ্ট বহির্মুখী চাপ এদের গ্রাভিটির অন্তর্মুখী টানকে নাকচ করে দেয়। ফলে আর সংকুচিত হয় না। যতসময় এই ফিউশন চলে ততসময় একটি নক্ষত্রের জীবদ্দশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও জ্বালানী শেষ হওয়ার অনেকবছর পর সুপারনোভা ঘটে, নক্ষত্রে অন্তিম যাত্রা।
নক্ষত্ররা অন্য নক্ষত্রের কাছাকাছি থাকলে গুচ্ছাকারে তাদের জীবন শুরু হয়। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘরতে কখনো অন্য নক্ষত্রের টানে এই গুচ্ছ থেকে বেরিয়েও যায়। একা বা অন্য একটা-দুইটা নক্ষত্রের সাথে দল বেঁধে জীবন কাটিয়ে দেয়।
অভিকর্ষের টানে আটকে পরে কয়েকটি নক্ষত্র একে অপরকে আবর্তন করলে তাকে বলে স্টার সিস্টেম বা স্টেলার সিস্টেম। কয়টি নক্ষত্র এ সিস্টেমে আছে তার উপর ভিত্তি করে স্টার সিস্টেমের স্রেণিবিভাগ করা হয়।
১) বাইনারি স্টার সিস্টেম: দুইটি নক্ষত্র একে অপরের মহাকর্ষের টানে আটকা পড়েছে। এরা একটি বেরিকেন্দ্রের চারপাশে ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে৷ দুটি নক্ষত্র নিয়ে এই সিস্টেম গঠিত হয় বলে এর নাম বাইনারি স্টার সিস্টেম হয়েছে। কখনো কখনো এমন দুইটি নক্ষত্রের মধ্যে ভরের আদান-প্রদানও হয়ে থাকে।
২) মাল্টিপল স্টার সিস্টেম: তিনটি বা তার অধিক নক্ষত্র এক্ষেত্রে একে অপরের মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই স্টার সিস্টেম কে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। এ বিভাজন মূলত এদের গতিশীলতার উপরে:
ক) হায়ারার্কিকাল স্টার সিস্টেম (স্থায়ী)
খ) ট্রাপিজিয়া (অস্থায়ী)
মাল্টিপল স্টার সিস্টেমে নক্ষত্রের একটি বড় গ্রুপ পুরো সিস্টেমের ভরকেন্দ্র কে ঘিরে অপেক্ষাকৃত বড় কক্ষপথে আবর্তনশীল থাকে।
প্রোটন প্রোটন চক্র

যা হোক, আবার ফিরে আসি নক্ষত্রের গহীনে। আগেই বলেছি ভরের উপর নক্ষত্রের সবকিছু নির্ভর করে। নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের ১.৩ গুণ থেকে কম হয় তবে এখানে মূলত প্রোটন-প্রোটন চক্রের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে প্রোটোনের গতিশক্তি এতবেশি থাকে যে, দুইটি প্রোটনের মাঝে যে কুলম্ব ফোর্স (বিকর্ষন), সেটা অতিক্রম করেই প্রোটন দুটি একে অপরের উপর পতিত হয় বা ফিউশন ঘটে৷ শুরু হয় চক্র। এবার প্রোটন-প্রোটন চক্র কি তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
এক কথায় আমাদের সূর্যে যে ফিউশন ঘটে সেটাই প্রোটন-প্রোটন চক্র। এই চক্রের শুরুটা হয় হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস (প্রোটন) দিয়ে আর শেষ হয় হিলিয়াম নিউক্লিয়াস দিয়ে। পুরো পদ্ধতি সংক্ষেপে বললে-
i) দুইটা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একত্র হয়ে একটি হাইড্রোজেন-২ (ডিউটেরিয়াম H) নিউক্লিয়াস হলো। এসময় একটি পজিটিভ ইলেক্ট্রন (পজিট্রন e⁺) আর একটি নিউট্রিনো নিঃসৃত হলো।
H⁺ + H⁺=²H + e⁺ + υₑ
ii) এবার একটা হাইড্রোজেন-২ নিউক্লিয়াস আরেকটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সাথে একত্র হয়ে হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস এবং গামা রশ্মি নির্গত হবে।
²H + H⁺= ³He²⁺ + γ
iii) আগের পয়েন্ট পর্যন্ত বিক্রিয়া সাধারণ। এই পর্যন্ত হওয়ার পর নানা উপায়ে হাইড্রোজেন-২ নিউক্লিয়াস হতে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয়। তবে পূর্ণ বিক্রিয়ার ধাপ গুলো যাই-ই হোক, সর্বশেষ বিক্রিয়া হবে,
4 H⁺ = ⁴He²⁺ + 2e⁺ + 2υₑ
এখানে আমি সেই পদ্ধতিটি তুলে ধরছি যেটিতে সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয়। মূলত এই বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে একটি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস থাকে যেটি উৎপন্ন হয় দুটি হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস হতে।
দুটি হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস তৈরী হয়। সাথে উপজাত হিসেবে দুটি প্রোটন উৎপন্ন হয়।
³He²⁺+³He²⁺=⁴He²⁺ + H⁺+H⁺
iv) এরপর একটি হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াস এবং একটি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি বেরিলিয়াম-৭ নিউক্লিয়াস ও গামা রশ্মি উৎপন্ন করে।
³He²⁺+⁴He=⁷Be+γ
v) এরপর এই বেরিলিয়াম-৭ আরেকটি প্রোটনের সাথে একত্রিত হয়ে একটি বোরন-৮ নিউক্লিয়াস ও গামা রশ্মি উৎপন্ন করে।
⁷Be+H⁺=⁸B+γ
vi) এরপর এই বোরন-৮ নিউক্লিয়াসটির রূপান্তর ঘটে। একটা পজিট্রন, ইলেক্ট্রন নিউট্রিনো নিঃসরণ ঘটে এর নিউক্লিয়াস হতে। তৈরী হয় বেরিলিয়াম-৮ নিউক্লিয়াস যা ভেঙে গিয়ে ২ টি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।
⁸B=⁸Be+ e⁺ +υₑ
⁸Be=2 ⁴He²⁺
প্রোটন-প্রোটন চক্র সম্পূর্ণ হলো। আসলে কেনো এটাকে চেইন রিঅ্যাকশন বলা যায়? কারণ শেষে উৎপন্ন হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস নতুন কোনো হিলিয়াম-৩ নিউক্লিয়াসের সাথে ফিউশন ঘটিয়ে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
কার্বন নাইট্রোজেন চক্র

যখন নক্ষত্রের ভর ১.৩ গুণ থেকে বেশি হয় তখন? তখন যে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে তার নাম CNO cycle বা কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্র। এমন নয় এই চক্র আমাদের সূর্য বা ১.৩ সূর্যভরের কম নক্ষত্রে দেখা যায় না। তবে খুবই কম পরিমাণে। আর অতি ভরের নক্ষত্রের CNO চক্র থেকে একটু ভিন্ন। যেহেতু এই চক্র আমাদের সূর্যের মতো কম ভরের নক্ষত্রের মূল শক্তির উৎস নয়, তাই আমরা শুধু সেই চক্রটা জানব যেটা অতি ভরের নক্ষত্রের মূল শক্তি উৎস হিসেবে কাজ করে। কথা না বাড়িয়ে চলুন এই চক্রটিও জেনে নেই:
i) বিক্রিয়ার শুরুতে একটি কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস যুক্ত হয় একটি প্রোটনের সাথে। উৎপন্ন হয় নাইট্রোজেন-১৩ নিউক্লিয়াস আর গামারশ্মি।
¹²C + H⁺ = ¹³N + γ
ii) নাইট্রোজেন-১৩ নিউক্লিয়াসটি হতে এরপর কটা পজিটিভ ইলেক্ট্রন বা পজিট্রন নির্গত হয় এবং এটি কার্বন-১৩ নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।
¹³N = ¹³C + e⁺ +γ
iii) এই কার্বন-১৩ নিউক্লিয়াসের সাথে ফিউশন ঘটে আরেকটি প্রোটনের, উৎপন্ন হয় নাইট্রোজেন-১৪ নিউক্লিয়াস। সাথে গামা রশ্মি তো আছেই।
¹³C + H⁺ = ¹⁴N + γ
iii) কার্বন, নাইট্রোজেনের পালা তো শেষ। এবার চক্রে আসছে অক্সিজেন। এজন্য নাইট্রোজেন-১৪ নিউক্লিয়াসটি আবার প্রোটন গ্রহণ করে, উৎপন্ন হয় অক্সিজেন-১৫ নিউক্লিয়াস যা খুবই অস্থায়ী।
¹⁴N + H⁺ = ¹⁵O
iv) উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথেই একটি পজিট্রন ছেড়ে দিয়ে নাইট্রোজেন -১৫ এর রুপ নেয়।
¹⁵O = ¹⁵N + e⁺
v) এই নাইট্রোজেন-১৫ নিউক্লিয়াসটি একটি প্রোটনের সাথে একত্র হয় এবং ভেঙে যায়। ভেঙে গিয়ে সেই চক্রের শুরুর কার্বন-১২ নিউক্লিয়াস নক্ষত্রকে ফেরত দেয় আর সাথে একটি হিলিয়াম-৪ নিউক্লিয়াস।
¹⁵N + H⁺ = ¹²C + ⁴He
একটা কথা বলে রাখা ভালো, CNO চক্র ৬ ভাবে সম্পন্ন হতে পারে। এখানে সবথেকে কমন এবং বেশি শক্তি উৎপন্ন হয় যে চক্রে সেটা ব্যাখা করেছি। প্রোটন-প্রোটন চক্রের ক্ষেত্রে একই কথা। প্রতিটা বিক্রিয়ায় কিছু পরিমাণ ভর খোয়া যায়। এই যে নিউট্রিনো, গামা রেডিয়েশন ঘটে। এই খোয়া যাওয়া ভরই আমরা শক্তি হিসেবে পাই, আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভরশক্তি সমীকরণ E=mc² মেনে।
এই যে ফিউশনের ফলে শক্তি সৃষ্টি হয়, এই শক্তি নক্ষত্রের বহিপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত হয়। ফলে নক্ষত্র হয় উজ্জ্বল। নক্ষত্রের এই উজ্জ্বল বহিপৃষ্ঠ ফটোস্ফেয়ার নামে পরিচিত।
পরিশিষ্ট
অবশেষে একটি মূল ধারার নক্ষত্র তার হাসিখুশি জীবনযাপন শুরু করলো। এখানেই সমাপ্ত মূল কথা সব। এই প্রবন্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে যা যা উপেক্ষা করা হয়েছে-
১) নেবুলা বা অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর নামকরণ। নক্ষত্রের জন্মপ্রক্রিয়া বুঝতে এর দরকার নাই।
২) প্রোটন-প্রোটন চক্রের সবথেকে বেশি শক্তি উৎপাদনকারী বিক্রিয়াটা এখানে ব্যাখা করেছি। CNO চক্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
৩) মাল্টিপল স্টার সিস্টেমের শ্রেণিবিভাগ দেখিয়েছি। তাদের ব্যাখা দেইনি। তাহলে বেরিকেন্দ্র, টু বডি প্রবলেম ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় আনা লাগতো যারা নিজেরাই অন্তত জটিল এবং বিস্তর আলোচনার জিনিস।
প্রবন্ধ শেষ করার আগে আমাদের সূর্যে যেভাবে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে সেটাও দেখে নেব। এটাও প্রোটন প্রোটন চক্র। উপরের বিক্রিয়া থেকে এর সামান্য একটু পার্থক্য। তবু, আমাদের নক্ষত্রকে না হয় একটু বিশেষ গুরুত্ব দিলামই।
আসলে উপরে প্রোটন-প্রোটন চক্রের যে কলাকৌশল দেখালাম সেটাই প্রযোজ্য, কিন্তু সূর্যে ডিউটেরিয়াম খুবই কম উৎপন্ন হয়। বরং দুইটি প্রোটন মিলে হয় একটি ডাইপ্রোটন (হিলিয়াম-২ নিউক্লিয়াস) যা খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং সাথে সাথে ভেঙে যায়। যার ফলে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরীর প্রক্রিয়া অনেক ধীর আর তাই সূর্যের শক্তিও কম। সূর্যে মূলত উপরের বর্ণিত প্রোটন-প্রোটন চক্রের অর্ধেক ঘটে। পরবর্তীতে বেরিলিয়াম-বোরন স্টেজে বিক্রিয়া খুব কম পৌছায়। ফলে আরেকদফা শক্তি উৎপাদন কমে যায়।
H⁺ + H⁺=²He
²He + H⁺= ³He²⁺ + e⁺ + γ
³He²⁺+³He²⁺=⁴He²⁺ + H⁺+H⁺
আমাদের সূর্যের সিংহভাগ বিক্রিয়া এভাবে ঘটে। আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি। আমরা জেনেছি সূর্য বা যেকোনো নক্ষত্রের একদম ভিতরে অভ্যন্তরে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটে। এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় উৎপন্ন ফোটন বেশ কিছু স্তর অতিক্রম করে, অতঃপর পৃথিবীতে পৌছায়।
ফোটন তৈরী → রেডিয়েশন জোন → কনভেকশন জোন → সূর্যপৃষ্ঠ → পৃথিবী।
রেডিয়েশন জোন এবং কনভেকশন জোনে থাকা পরমাণু উৎপন্ন আলোর ফোটনকে বারবার শোষণ নিঃসরণ করে, তারপর এই আলোর ফোটন পৃষ্ঠে পৌছায়। কয়েক কোটি বার শোষণ বিকিরণ ঘটে বলে কোর থেকে পৃষ্ঠে আলো পৌছাতেই প্রায় দেড় লক্ষাধিক বছর খরচ হয়! অর্থাৎ আমরা বর্তমানে সূর্য থেকে যে আলো পাচ্ছি তা লক্ষ বছর আগের। আমাদের কথা আজকের মতে ফুরালো, এখানেই শেষ হলো নক্ষত্রের জন্মগাঁথা।
লেখকঃ প্রজেশ দত্ত
©সত্ত্বঃ প্রজেশ দত্ত, তিকতালিক