আমরা যখন আমাদের ইতিহাস জানতে বসি, এটি আমাদের এমন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি করায়, যা কোনো রূপকথায়ও পাওয়া যায়না। এগুলো আমাদের কোনোদিন জানানো হয়নি, কিংবা সেগুলি কোনো কবি গানেও গাওয়া হয়নি। আসুন আজকে আমরা আমাদের ইতিহাসের ঝলক দেখে আসি, সাথে পরিচিত হয়ে আসি আমাদের আরেক আত্মীয়ের সাথে। “ডিম আগে নাকি মুরগী” শীর্ষক প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করেছিলাম অ্যামনিওটদের কথা। বিবর্তনে প্রথম যারা আধুনিক ডিম পাড়া শুরু করে তাদের নাম অ্যামনিওট (Amniote), আজকের আমরা স্তন্যপায়ীরা, সরিসৃপ কিংবা পাখিরা সবাই এই অ্যামনিওট গোষ্ঠী থেকেই বিবর্তিত হয়েছি। আজ থেকে ৩৪ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হেঁটে বেড়াতো আমাদের অ্যামনিওটদের পূর্বপুরুষ ক্যাসিনেরিয়া (casineria)। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে তখন বিরাজ করছে অদ্ভুত এক যুগ! সে যুগের আকাশে উড়ে বেড়ায় দৈত্যাকার সব পোকামাকড়, রূপকথার মতো। যুগের নাম কার্বনিফেরাস যুগ। এই বিশাল বিশাল আকৃতির কীটপতঙ্গের রাজ্যে ছোট্ট ক্যাসিনেরিয়া তখন নিজেও জানতো না, তার উত্তরসূরীরাও একদিন এই পৃথিবীতেই রাজত্ব করবে৷ আকাশ, স্থল, জল—সবখানে ছড়িয়ে যাবে তার সন্তানেরা। ক্যাসিনেরিয়ারা ডিমের মাধ্যমে প্রজনন ঘটাতো। যেটা এখনও তাদের উত্তরসুরীদের মধ্যে রয়ে গেছে পুরোপুরিভাবেই, আবার কারোর মধ্যে ঘটেছে একটুখানি পরিবর্তন।
পাখি এবং আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ মিল হচ্ছে, আমরা উভয়ই এসেছি ডিম থেকে। পাখির ভ্রূণের পরিস্ফুটনের সময় ভ্রূণে সৃষ্টি হয় কুসুম থলি (Yolk sac)। কুসুম থলি হচ্ছে, ভ্রূণের মধ্যান্ত্রের সঙ্গে যুক্ত এবং এন্ডোডার্ম ও মেসোডার্ম গঠিত অপেক্ষাকৃত ছোটো থলি আকৃতির তরলে পূর্ণ ঝিল্লি। পাখি এবং সরিসৃপদের কুসুম এই কুসুম থলি দ্বারা আবৃত থাকে। একটা শিশু পাখি বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় পুষ্টি এই কুসুম থলি থেকেই আসে। অন্যদিকে, মানুষের ডিম অনেক ক্ষুদ্র। কতোটা ক্ষুদ্র, তা কল্পনা করতে পারবেন, তার আকার জানলেই। মানুষের ডিমের আকার হচ্ছে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ। পাখি এবং সরীসৃপদের মতো আমাদের ডিমের কোনো কুসুম কিংবা খোলস তৈরি হয় না। আমরা ভ্রূণাবস্থায় পুষ্টি এবং নিরাপত্তা পাই আমাদের মায়ের শরীর থেকে।
এখন। আপনার মনেই হতে পারে যে, যেহেতু মানবদেহে কুসুম সৃষ্টি হয় না, তাই হয়তো কুসুম থলিও তৈরি হয় না। কিন্তু না! কোনো এক কারণে, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও, আবার পড়ুন, “প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও” ভ্রূণের পরিস্ফুটনের সময় মানবদেহেও কুসুমথলি তৈরি হয় এবং একসময় সেটা বিলুপ্তও হয়ে যায়। ঠিক এখানেই অবধারিতভাবে আমাদের শরীরে ফুটে ওঠে কোটি কোটি বছর আগের এক পূর্বপুরুষের চিহ্ন! এটাই স্বাক্ষ্য দেয়- আমার, আপনার, আকাশে উড়া পাখি কিংবা একটু আগে আপনার ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাপটির একক ইতিহাসের। কিভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে ডুব দিতে হবে আমাদের কোষের ডিএনএ-র অভ্যন্তরে থাকা জিনের জগতে। কুসুম তৈরির অত্যাবশকীয় উপকরণ হচ্ছে, ভিটেলোজেনিন নামের একটি প্রোটিন। পাখি ও সরীসৃপদের জিনোমে পাওয়া যায় ভিটেলোজেনিন জিন (vitellogenin gene / VIT gene); যেটা ভিটেলোজেনিন প্রোটিন উৎপন্ন করে, যার মাধ্যমে ডিমের কুসুম গঠিত হয়। কথা হচ্ছে, আমাদের দেহেও কি এই জিন আছে? যদি আমরা এমন কোনো পূর্বপুরুষ থেকে এসে থাকি, যাদের প্রজনন ঘটতো সুগঠিত কুসুমের, শক্ত খোলসের ডিম দেয়ার মাধ্যমে, তাহলে আমাদের ডিএনএ-তেও এর কোনো না কোনো অতীত চিহ্ন থেকে যাওয়ার কথা। এবং সেটা আছেও! ২০০৮ সালে বিখ্যাত সুইস ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এর অর্থায়নে এক গবেষণায় ঠিক তেমনটাই পাওয়া গেছে। আমাদের জিনোমে পাওয়া গিয়েছে কোটি বছর আগের সক্রিয় ভিটেলোজেনিন জিনের ভগ্নাংশ! ঠিক যেভাবে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যগুলি দাঁড়িয়ে থাকে।
এই গবেষণা পরিচালনা করা তিনজন প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডেভিড ব্রাওয়ান্ড, ওয়াল্টার ওয়াহলি, হেনরিক ক্যাসম্যান আমাদের জিনোমের সাথে পাখির জিনোমের তুলনা করার সময় আরেকটা চমৎকার ব্যাপার লক্ষ্য করলেন। তারা দেখলেন, পাখির জিনোমে থাকা ভিটেলোজেনিন জিন এর পাশাপাশি যেসব প্রতিবেশী জিন আছে, আমাদের জিনোমে থাকা এই ভিটেলোজেনিন জিনের ভগ্নাংশের পাশেও হুবহু একই প্রতিবেশী জিনগুলি আছে কোনোপ্রকার ভিন্নতা নেই!! পাখির যেমন VIT1 এর পাশে আছে ELTD1 জিন; ঠিক একইভাবে মানব ডিএনএতেও ELTD1 জিনের পাশেও আর কোনো জিন না বরং VIT জিনের ভগ্নাংশই উপস্থিত! পাখির জিনোমের SSX2IP জিন, CTBS জিনের পাশে VIT জিন; একই ভাবে আমাদেরও SSX2IP জিন, CTBS জিনের পাশে VIT জিনের ভগ্নাংশ! এতো নিখুঁত সাদৃশ্যতা তখনই সম্ভব— যদি আপনি, আমি, অন্ধকারে গাছের মগডালে বসে থাকা ঐ হুতুমপেঁচা, আমরা সবাই যদি একই পূর্বপুরুষ থেকে আসি তবেই। আমাদের পুরো ডিএনএ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোটি বছরের ইতিহাস। কোনোটি স্বাক্ষ্য দেয় অতীত সংক্রমণের, কোনোটি স্বাক্ষ্য দেয় আমাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাসের। এই ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে আপনাদের গল্প শুনিয়ে যাবে তিকতালিক।