সূর্যের জীবনকথন

সূর্যের জীবনকথন

সবার সামনে এসে দাঁড়ালেন আগন্তুক। দেবতাদের সভায় এমন আগন্তুকের প্রবেশ সবার চোখমুখে চিন্তার ছাপ এঁকে দিলো। এক দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে রইলেনন ফ্রে, ভাসির, ওডিন, লোকি সহ সকল দেবতারা।


“আমি আপনাদের জন্য প্রাচীর গড়ে দিতে রাজি মহামান্য ওডিন। আকাশসম উঁচু, দূর্ভেদ্য; দৈত্য হোক বা দানব, হোক পিঁপড়া বা ছোট্ট মশা, কিংবা হাজার হাতির শক্তি রাখা কোনো দেবতা- কেউই এই প্রাচীর ভেদ করে আপনাদের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না” – একরাশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আগন্তুকের বাণীগুলো গুঞ্জিত হলো সভায়।


“হ্যাঁ। আমাদেরও কারিগর আছেন। বামুনেরা এই নয় জগতের সেরা কারিগর। তাদের বদলে কেনো তোমাকেই আমরা বিশ্বাস করব? তোমার বিশেষত্ব কী? জানোই তো, সুযোগ তারাই পাওয়ার যোগ্যতা রাখে যারা অন্যের তুলনায় সেই সুযোগের অধিকতর সদ্ব্যবহারে সক্ষম” – সর্বপিতা ওডিনের কণ্ঠে নতুন এই কারিগরকে নিয়ে একইসাথে সন্দেহ এবং কণ্ঠার ছাপ।


কিন্তু আগন্তুক এখনো নিজের অবস্থানে অটুট, আরও দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস আর একটু অহংকার তার শব্দচয়নে। “নিঃসন্দেহে আপনার এই বামুনেরা সেরা, তবে তাদের একটা কমতি রয়েছে। এই কমতি হলো সময়। এরূপ প্রাচীর গড়ে তুলতে তাদের কয়েক বছর লেগে যাবে। ততদিনে হয়তো সর্বপিতা বুড়ো-ই হয়ে যাবেন আপনি। আমি মাত্র তিন ঋতুতে এই প্রাচীর আপনাদের উপহার দিতে পারি। জানেনই তো, সময়ের থেকে অধিক মূল্যবান এই নয়জগতে আর কিছুই নেই।”


আগন্তুকের এই প্রস্তাব মন্দ লাগলো না কোনো দেবতার। সর্বপিতা ওডিনও মৌনসম্মতি দিলেন। কিন্তু আগন্তুকের পারিশ্রমিক? এত বড় কার্যের জন্য নিশ্চয়ই কম কিছু দাবী করবে না সে। ওডিন অবশেষে আগন্তুকের দিকে চাইলেন।


-কি চাই তোমার?
-সূর্য
-কিহ?
-জি মহামান্য ওডিন। সাথে চাই চাঁদ এবং সুন্দরী ফ্রেয়া কে।


প্রথমে আপত্তি জানালেও শেষপর্যন্ত লোকির উস্কানিতে সূর্যকে বাজি রেখে আগন্তুকের সাথে এই চুক্তিতে রাজি হন দেবতারা। কিন্তু হারাতে হয়নি আমাদের সূর্যকে। লোকির অসাধারণ চাতুর্যে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলো আমাদের সূর্য, নয়তো সৌরজগতই হয়তো অন্ধকারে নিমজ্জিত হতো অনন্তকালের জন্য। আর আমরা হারাতাম আমাদের ত্রাণকর্তাকে।


শৈশবকাল থেকেই আমরা অন্তত একটা নক্ষত্রকে ভালো মত চিনতে শিখি। রোজ সকালে পূর্বে উঠে পশ্চিমে অস্ত যাওয়া আমাদের সূর্যকে, সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্রকে। থালার মতো গোল হয়ে আকাশে ঝুলে থাকলেও সূর্য মোটেও এত পিচ্চি না। প্রায় 6,96,340 কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এক মহাউত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড সে। এই উত্তপ্ত পিন্ড থেকে প্রতি মুহুর্তে আলো-তাপ আসছে পৃথিবীতে, জোগান দিচ্ছে পৃথিবীর সব জীবের প্রাণ-রাসায়নিক শক্তি।
সূর্যের জন্ম হয়েছে প্রায় 4.6 বিলিয়ন তথা 460 কোটি বছর আগে, আর কয়েকটা নক্ষত্রের মতোই বিশাল বড় গ্যাসীয় মেঘ থেকে। মহাকর্ষের অন্তমুখী টানে সংকুচিত থেকে সূর্য সৃষ্টির পর বাকি গ্যাসীয় উপাদান, মেঘ ডিস্কের মতে সূর্যকে ঘিরে ছিলো বহুবছর। মহাজাগতিক মেঘের এই অবশিষ্ট অংশ থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে পুরো সৌরজগত। আমাদের থেকে প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে সূর্য, আলো আসতে সময় লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। অন্তত আমরা সেখানে পৌছানোর চিন্তা করিনা সহজে। কিন্তু অনেকেই করেন।


এইতো সেদিন মফিজ আসলো আমার কাছে। ছেলেটার আগ্রহ সবকিছুতেই বড্ড বেশি। এসেই যা বললো আমাকে তাতে আমি থ হয়ে গেলাম। মুখটা হা হয়ে রইলো বেশ কিছু সময়। “ভাই, আমি সূর্যে যাব। এটা আমার জীবনের শেষ সিদ্ধান্ত ভাই। মানুষ চাঁদ, মঙ্গল সব জয় করেছে। আমি আমার দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই। আমি সরাসরি সূর্যেই যাব।” কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমি বললাম, “তা হঠাৎ মফিজের মনে এত সুখ কেনো? সূর্যে তোমার কী কাজ? কেউ কি ধোঁকা টোকা দিলো নাকি, সূর্যে ঝাঁপ দিয়ে মরার শখ কেনো উঠলো?”


-মরার কথা কে বলছে ভাই, আমিতো সূর্যকে জয় করতে চাচ্ছি।


-সেটাতো মৃত্যুর সমানই। এই দেখো ভর দুপুরে রোদের তাপে শরীর ঘেমে এককাকার। মানুষজন পাখা চালিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না। আর তুমি যাবে সেখানে যেখান থেকে এই তাপের সৃষ্টি?

  • আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে ভাই। আমি বরফের স্যুট পরব ভাই। আইসস্যুট পরে সূর্যে গেলে আমার আর গরম লাগবে না।
    -আজকের তাপমাত্রা কত জানো? খুব বেশি হলে 35 ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই তাপেই তোমার ঐ আইসস্যুট গলে পানি হয়ে ঝরে যাবে। আর সূর্যের পৃষ্টের তাপমাত্রা তো 5505 ডিগ্রী সেলসিয়াস!! কত গুণ তা নিশ্চয়ই বুঝছো?
    -এত তাপ! এত তাপ তো আমাদের উনুনেও হয়না কখনো।
  • হা হা হা। আমাদের চুলায় জ্বলা আগুন আর সূর্যের আগুন (আসলে সূর্যে কোনো আগুন জ্বলেনা) এক না। আমাদের চুলায় যে আগুন জ্বলে তা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কিছু জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার ফল। আর সূর্যে ঘটে ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় এতটুকু তাপ তৈরী হওয়া সাধারণ ব্যাপার।

-কেউ যদি সূর্যে এক মহাসমুদ্র পানি ঢেলে দিতো তাহলে বড্ড সহজে আমি সূর্যে পাড়ি জমাতে পারতাম।


-না হে মফিজ, এতে সূর্য আরো অধিক তীব্রতায় জ্বলজ্বল করতে থাকবে। কারণ পানিতে রয়েছে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন পরমাণু। তুমি যখন সূর্যের পানি দিচ্ছো, তখন তুমি মূলত সূর্যে বিক্রিয়া ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় হাইড্রোজেন পরমাণুর বিশাল জোগান দিচ্ছো। অর্থাৎ সূর্যে আরও দ্রুত ফিউশন ঘটবে, সূর্যের উজ্জ্বলতা কয়েকগুণ বাড়বে।


-এখন উপায়? আমি কি সূর্যে যেতে পারব না?
-এক কাজ করো, তুমি বরং রাতের বেলা চলে যাও সূর্যে, তখন সূর্যে আলো থাকেনা।
-ঠিক বলেছেন ভাই, ভাই আপনি সেরা ভাই।


সৌরজগতের মোট ভরের প্রায় 99.46% ভর ধারণ করে বসে আছে আমাদের সূয্যি মামা। এই দানবের মোট উপাদানের 73.46 শতাংশ হলো হাইড্রোজেন। পর্যায় সারণীতে যত মৌল রয়েছে তাদের মধ্যে সবথেকে হালকা মৌল। কে জানে, হয়তো কবি সেদিন আকাশে এই সূর্যের দিকে তাকিয়েই বলে গেছেন,
“ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।”
সূর্যের বাকি উপাদানের মধ্যে 24.85 শতাংশ হিলিয়াম। আর সামান্য পরিমাণে কার্বন, আয়রন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার প্রভৃতিও উপস্থিত। সূর্যের গহীনে যেখানে প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলেছে ফিউশন বিক্রিয়া সেটি খুবই উত্তপ্ত, প্রতি সেকেন্ডে সেখানে 600 মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন ফিউজ হয়ে উৎপন্ন হচ্ছে হিলিয়াম। যার মধ্যে মাত্র চার মিলিয়ন টনের মতো (0.7 শতাংশ) ভর আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমীকরণ মেনে শক্তিতে পরিণত হয়। বিক্রিয়াস্থল তথা সূর্যের কোর এর কেন্দ্রের চারপাশের 20-25% এলাকা নিয়ে গঠিত। সূর্যে উৎপন্ন এই শক্তি কোর থেকে পৃষ্ঠতল এবং পৃষ্ঠতল থেকে বাইরে উন্মুক্ত হতে সময় নেয় প্রায় দশ থেকে একশত সত্তর হাজার বছর। আপনি যখন শীতের দুপুরে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে সূয্যি মামাকে ধন্যবাদ দেন আপনাকে উত্তপ্ত রাখার জন্য, তখন আপনি কমপক্ষে দশ হাজার বছর অতীতের তাপ অনুভব করেন, আলো দেখেন। সূর্যের কোরের তাপমাত্রা প্রায় 15.7 মিলিয়ন কেলভিন।


তাপ তিন ভাবে এক স্থান থেকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। পরিবহন, পরিচলন এবং বিকিরণ। সূর্যের কোরের বাইরে রেডিয়াটিভ অঞ্জলের অবস্থান। কোরের সীমানা থেকে সূর্যের প্রায় 70% অঞ্চল অবদি এর বিস্তৃতি। কোর থেকে যত দূরের অঞ্চলে আমরা যাই তত তাপমাত্রা কমতে থাকে। রেডিয়াটিভ অঞ্চলের প্লাজমা অনেক বেশি উত্তপ্ত এবং ঘন হওয়ায় তাপ সেখানে বিকিরণের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। কোরের 15.7 মিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রা রেডিয়াটিভ অঞ্চলের শুরুতে নেমে যায় 7 মিলিয়ন কেলভিনে। সেখানে ফিউশনের মতো কোনো বিক্রিয়া ঘটেনা বলেই এই পার্থক্য, আরও দুরে গেলে তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমে রেডিয়াটিভ অঞ্চলের সীমানায় প্রায় 2 মিলিয়ন কেলভিনে নেমে আসে।


রেডিয়াটিভ অঞ্চলের পর কনভেকটিভ অঞ্চল। কনভেকশন হলো তাপের পরিচলন। এর পিছনে দায়ী ঐ লেয়ারের প্লাজমা অপেক্ষাকৃত কম উত্তপ্ত ও ঘন হওয়া। এই অঞ্চল রেডিয়াটিভ অঞ্চলের শেষ সীমা থেকে শুরু হয়ে প্রায় পৃষ্ঠতল অবদি বিস্তৃত। রেডিয়াটিভ আর কনভেকটিভ অঞ্চলের মাঝে ট্যাকোলিন আস্তরণের অবস্থান। কনভেকটিভ অঞ্চলে এসে তাপমাত্রা আরও নিচে যায়। 2 মিলিয়ন কেলভিন থেকে নেমে আসে মাত্র 5700 কেলভিনে।


এরপর ফটোস্ফিয়ার অঞ্চলের অবস্থান। আমাদের চোখে সূর্যের যে অংশ ধরা দেয়। আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে সূর্য থেকে। এই আলোর বিকিরণই পাড়ি জমায় দূর-দূরান্তে নিজের প্রিয়তমাদের কাছে।


অঙ্গে তোমার রূপের খনি, বিভৎসতার আড়ি
যতই হও রূপের রাজা, কলঙ্ক না ছাড়ি।


নক্ষত্র হও বা মানুষ, তোমার যদি কলঙ্ক না থাকে তবে তুমি যেন পরিপূর্ণ নও; এমন কিছু আমাদের সূর্যের জন্যও সত্য। সূর্যের গাত্রেও রয়েছে কলঙ্ক। সূর্যের ইনটেন্স ম্যাগনেটিক ফিল্ডের জন্য সূর্যপৃষ্ঠ তথা ফটোস্ফিয়ারের কোথাও কোথাও স্পট সৃষ্টি হয় যার তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম হয়ে থাকে। কিন্তু এতোটাও কম না যা যে মফিজ ভাইয়ের মতো আপনি সেখানে ঝাঁপ দেওয়ার পরিকল্পনা করবেন। সানস্পটের তাপমাত্রা প্রায় 3800 কেলভিন।

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বোঝা গেছে সূর্য নিজের অক্ষেও ঘূর্ননশীল। যেহেতু সূর্য কোনো সলিড বস্তু না সেহেতু এর বিভন্ন লেয়ারের ঘূর্ণনকালে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সাময়িকভাবে এই স্পট সূর্যপৃষ্ঠে সৃষ্ট হয়, প্রায় 50000 কিমি পর্যন্ত হতে পারে এর ব্যাসার্ধ। সূর্যের ফটোস্ফিয়ার অঞ্চলের শেষে সূর্যকে ঘিরে আছে ক্রোমোস্ফিয়ার। এই অঞ্চল থেকে লালচে আভা ছড়ায়। সূর্যের প্রচন্ড তাপে হাইড্রোজেনের দহন ঘটে এই অঞ্চলে। এই লালচে আভা আমরা চাইলেও দেখতে পাইনা কারণ এর পিছনেই আছে উজ্জ্বল ফটোস্ফিয়ার। এর আলোয় ঢাকা পড়ে যায় লাজুক মুখের লালচে আভা। সূর্যগ্রহণের সময় প্রকাশ পায় সে। ঠিকরে বেরিয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়।


এবার সূর্যের সবচেয়ে বাইরের স্তর নিয়ে জানব। নামটা শুনে একটু চমকই জাগবে মনে। সবচেয়ে বাইরের লেয়ারটার নাম “করোনা।” জি, সঠিক শুনেছেন। করোনা তার নাম, এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ণ সূর্যগ্রহনের সময়৷ এসময় সাদা আলোকরশ্মি বা শিখারূপে নিজেকে প্রকাশ করে সে। উত্তপ্ত আয়নিত গ্যাসরূপে ছুটে চলে সূর্য থেকে বাইরের দিকে, মহাকাশে। এর তাপমাত্রা প্রায় 2 মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন হতে পারে। এবার যে রহস্য সামনে আসে তা হলো সূর্যের কোর থেকে যত বাইরের দিকে আসি আমরা তত তাপমাত্রা কমতে থাকে। তাহলে হঠাৎ করে সবচেয়ে বাইরের এই লেয়ারের তাপমাত্রা এত বেশি কিভাবে হয়ে গেলো?


এই প্রশ্ন অনেক ভাবিয়েছে বিজ্ঞানীদের। অবশেষে তারা একটা ব্যাখা দাঁড় করিয়েছেন। সূর্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছোটো ছোটো বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয় এসব উত্তপ্ত আয়নিত গ্যাসকণা। এই বিষ্ফোরণ গ্যাসকণাগুলির তাপমাত্রাকে পৌছে দেয়ে অনেক উঁচুতে। তাদের হিসেবে এমন বিষ্ফোরণে সৃষ্ট গ্যাসকণার তাপমাত্রা দশ মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াসও হতে পারে। এই ধরনের বিস্ফোরণ ন্যানোফ্লার নামে পরিচিত। আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ যেমন জায়ান্ট সুপার টর্নেডোকেও তাপমাত্রার এমন বৃদ্ধির পিছনে দায়ী করা হলেও ন্যানোফ্লারই মূল ভূমিকা রাখে বলে বিবেচনা করা হয়। এই যে করোনা, উত্তপ্ত গ্যাসকণা; এগুলো ছুটতে ছুটতে একসময় তাপ হারিয়ে ঠান্ডা হয়ে যায়, সৃষ্টি করে সৌরঝড়ের।


“নক্ষত্রের জন্মকথন” প্রবন্ধটা আমরা শেষ করেছিলাম আমাদের সৌরজগতের কর্তাধর্তা এই সূর্যের গল্প দিয়ে। মূল ধারার সকল নক্ষত্রের মতো সূর্য আপন মহিমায় জ্বলজ্বল করছে ফিউশন প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে। আমাদের সূর্যের জ্বালানী হলো হাইড্রোজেন। এই হাইড্রোজেনের ফিউশনেই সূর্যে উৎপন্ন হয় তাপ এবং আলো যেটা দিয়েই পৃথিবীতে এখনো প্রাণ টিকে আছে। সূর্যে যে প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেনের ফিউশন ঘটে সেটাকে বলা হয় প্রোটন প্রোটন চক্র। সকল মূল ধারার নক্ষত্রে এই চক্র মোটামুটি একই রকমই থাকে, সামান্য পার্থক্য হতেও পারে।


যেমন সূর্যে ডিউটেরিয়াম প্রোটন প্রোটন ফিউশনে ডিউটেরিয়াম খুবই কম উৎপন্ন হয়। বরং দুইটি প্রোটন (হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস) মিলে তৈরী হয় একটি ডাইপ্রোটন (হিলিয়াম-২ নিউক্লিয়াস) যা খুবই ক্ষণস্থায়ী এবং সাথে সাথে ভেঙে যায়। যার ফলে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরীর প্রক্রিয়া অনেক ধীর আর তাই সূর্যের শক্তিও কম। পরবর্তীতে বেরিলিয়াম-বোরন স্টেজে বিক্রিয়া খুব কম পৌছায়। ফলে আরেকদফা শক্তি উৎপাদন কমে যায়।


H⁺ + H⁺=²He
²He + H⁺= ³He²⁺ + e⁺ + γ
³He²⁺+³He²⁺=⁴He²⁺ + H⁺+H⁺


আমাদের সূর্যের মোট ভর 2×10^30 kg, এর মধ্যে দশ শতাংশ পরিমাণ ভর থাকে সূর্যের কেন্দ্রে যেখানে ফিউশন ঘটে। অর্থাৎ প্রায় 2×10^29 কেজি ভর থাকে কেন্দ্রে। এই যে কেন্দ্রের ভর এর প্রায় 75 শতাংশই হাইড্রোজেন, 1.5×10^29 কেজি হাইড্রোজেন। আমরা সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেনের পরিমাণ পেয়ে গেলাম। পূর্ব আলোচনা হতে আমরা দেখেছি এই হাইড্রোজেন ফিউশন থেকেই আমরা পাচ্ছি শক্তি, প্রাণশক্তি। প্রোটন প্রোটন চক্রে যখন হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম উৎপন্ন হয় তখন 0.7 শতাংশ হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হয় শক্তি, আইনস্টাইনের ভর শক্তি সমতুল্যতার সূত্র অনুসারে। এক্ষেত্রে তাহলে পুরো জীবদ্দশায় সূর্য হতে শক্তি পাওয়া যাবে 0.007 × ভর × c^2 তথা 9.45×10^44 জুল। জন্ম থেকে মৃত্যু অবদি সূর্য আমাদের মোট এই শক্তি প্রদান করবে। এখন প্রশ্ন থেকে যায় সূর্য আর কতবছর বাঁচবে? আমাদের ত্রাণকর্তা আর কতবছর আমাদের শক্তির জোগান দিবে?


এই হিসাবও মোটামুটি সহজে করা যায়। প্রথমে উজ্জ্বলতা (Luminosity) তথা প্রতি সেকেন্ডে সূর্য হতে বিকিরিত তাপশক্তি জানতে হবে, এই শক্তি 3.846×10^26 জুল। তাহলে হাইড্রোজেন হতে সৃষ্ট শক্তি বিকিরিত হয়ে শেষ হতে সময় লাগবে (9.45×10^44 ÷ 3.846×10^26 ) সেকেন্ড বা 2.46×10^17 সেকেন্ড যেটাকে বছরে রূপান্তরিত করলে প্রায় 8 বিলিয়ন বছর হয়। অর্থাৎ সূর্যের আয়ু কমপক্ষে 8 বিলিয়ন বছর বা 800 কোটি বছর। কমপক্ষে বলার পিছনে কারণও রয়েছে। ভবিষ্যতে সূর্যের জ্বালানি তত কমবে, কোরে থাকা হাইড্রোজেন আর সূর্যের ভর যত কমবে, ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় চাপও তত কমবে। ফলে ফিউশনের হারও বর্তমানের তুলনায় কমবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ হাইড্রোজেন শেষ হয়ে সূর্য নিভতে প্রয়েজনীয় সময় আমরা যেটা হিসাব করে নির্ণয় করলাম, বাস্তবে সময় এটা থেকে আরও বেশি লাগবে, প্রায় 8 বিলিয়ন বছর! সূর্যের আয়ুস্কাল প্রায় এই 10 বিলিয়ন বছর বা 1000 কোটি বছর।


সূর্য ইতোমধ্যেই নিজের আয়ুর প্রায় অর্ধেক জীবনকাল শেষ করে ফেলেছে! তবে ভয় পাবার এখনো তেমন কোনো কারণ নেই। 4.5 বিলিয়ন বা 450 কোটি বছর ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এখনো প্রায় 4.5 বিলিয়ন বা 450 কোটি বছর তার আয়ু আছে! তারপরেই পুরো ঠান্ডা হয়ে হয়ে যাবে আমাদের সূর্য। আর মাত্র 400 কোটি বছরের মধ্যেই এর আয়তন বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমাদের এই সবুজ পৃথিবীসহ সকল গ্রহকেই একের পর এক গিলতে শুরু করবে। নিজেও মরবে তার সঙ্গে সৌরজগতের আর কাউকে বাঁচতেও দেবে না। আজ থেকে 500-550 কোটি বছর পর সূর্য পরিনত হবে একটা লাল দৈত্যে বা রেড জায়ান্টে! তারপর পরিনত হবে একটি শ্বেত বামন বা হোয়াইট ডোয়ার্ফে! শেষ। সবকিছুই এখানে পরিসমাপ্ত।


লেখক: তিকতালিকীয় সদস্যবৃন্দ
কপিরাইট: তিকতালিক-Tiktaalik

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *