কাঁচা মাংস ভক্ষণ

কাঁচা মাংস ভক্ষণ

২০১৬ সালের ৯ মার্চ, লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে নেটবার্ণ নামক একজন লেখক কাঁচা মাংস ভক্ষণ নিয়ে নৃতত্ত্ববিদ ও জীবাশ্মবিদ ড্যানিয়েল লিবারম্যানের গবেষণা এবং লিবারম্যানের মতামত তুলে ধরেন। লিবারম্যান কাঁচা ছাগলের মাংস চিবিয়ে খেয়ে দেখেছেন রান্না এবং কাঁচা মাংস খাওয়ার পার্থক্য অনুধাবন করার জন্য।


নেকড়ে, সিংহের মতো কাঁচা মাংস খেয়ে থাকে এমন প্রাণীদের দাঁত থেকে আমাদের দাঁতে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। শুধুমাত্র এদের দাঁতের গঠনের জন্যই এরা কাঁচির মতো মাংস কুচি কুচি করে সহজে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে মাংস চিবানোর সময়। ফলে গলাধঃকরণে কোনোপ্রকার সমস্যা হয়না। কিন্তু আমাদের দাঁত কাঁচা মাংসের স্থিতিস্থাপকতাকে অতিক্রম করতে পারেনা। ফলে আমরা যখন চিবাই মাংস মোটেই টুকরো টুকরো হয়না। বরং দাঁতের চাপে পিষ্ট হয়ে একপ্রকার লালাযুক্ত মন্ডে পরিণত হয়ে যায়। লিবারম্যান কাঁচা মাংস চিবানোর সময় এই একই বিষয়ই অনুভব করেছেন। তিনি বলেছেন, কাঁচা মাংস আসলে নোনতা এবং শক্ত। মুখে দিয়ে চিবাতে থাকলেও কোনো বিশেষ উপকার পাওয়া যায়না গলাধঃকরণে।


আমাদের হোমিনিন পূর্বপুরুষরা গাছে গাছে ঘুরত এবং ফলমূল খেয়ে বেঁচে থাকতো। দুই পায়ে চলতে শেখার পরও এই গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানোটা আরও বহুকাল আমাদের পূর্বপুরুষদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিলো। ফল, বাদাম, পাতা, মূল, বীজ এবং পোকামাকড়- এসবই ছিলো প্রধান খাদ্য। কিন্তু এসব খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং ক্যালরি পেতে তাদের প্রায় সারাদিনই একটু সময় পর পর খাওয়া লাগতো। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিলো এমন খাদ্য উৎস খুঁজে বের করা যেনে সামান্য খাদ্য হলেই প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাওয়া যায়। এইরকম খাদ্য উৎসের সন্ধানেই হোমিনিনরা বেছে নেয় মাংসাশী প্রাণীদের উচ্ছিষ্ট খাদ্য, বিশেষ করে হাড়গোড় আর অস্থিমজ্জা। প্রায় তিন মিলিয়ন বছর আগে এভাবেই আমাদের খাদ্য তালিকায় এক বিশাল পরিবর্তন আসে।


সম্ভবত, তখনই মোটামুটি কোনো কোনো হোমিনিন গোষ্ঠীতে বড় স্কেলে মাংস ভক্ষণ শুরু হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অস্ট্রালোপিথেকাসরা প্রথম প্রাণী শিকার করে খাবার হিসেবে গ্রহণ শুরু করে। অস্ট্রালোপিথেকাসদের আদি বাসস্থান ছিলো তাঞ্জানিয়ায়। এই তাঞ্জানিয়ায় ছোট ঘোড়া, জিরাফ, চেয়াল, হায়েনা, বিশাল আকৃতির হাতি থাকতো। কিন্তু তখনও কোনো প্রকার ধারালো নিঁখুত অস্ত্র বা শিকার সরঞ্জামের আবির্ভাব হয়নাই বিধায় অস্ট্রালোপিথেকাসরা ব্যাঙ, খরগোশ, হাঁসই বেশি শিকার করে খেতো। এসব শিকারে তাদের অস্ত্র ছিলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর। গবেষকরা দেখেছেন, শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের ধারালো পাথর ব্যবহার করেই শিকার করা, মাংস হাড় থেকে আলাদা করা, মাংস কুচি কুচি করা, হাড় ভেঙে মজ্জা আলাদা করার কাজ করতো তারা। এইসকল ধারালো পাথরের ব্যবহার থেকেই ধীরে ধীরে পরবর্তীতে “আধুনিক পাথুরে অস্ত্র” তৈরীর জোয়ার আসে। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলোপিথেকাসরা গাছের ডাল, লাঠির মাথা সূঁচালো করে বল্লম সদৃশ কিছু একটা বানিয়েছিলো যা প্রতিরক্ষার কাজে এরা ব্যবহার করতো।


যেমনটা বললাম, এই অস্ট্রালোপিথেকাসদের ব্যবহার করা ধারালো পাথরগুলো সাধারণত চারপাশের প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, এগুলো ঠিক হাতে তৈরী না বলে এগুলোকে অস্ত্র বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়না। পাথর ঘষে ঘষে তীক্ষ্ম করে মাংস কাটা কিংবা টুকটাক শিকারের সরঞ্জাম (টুল) বানানোর প্রথম কৃতিত্ব আসলে হোমো হাবিলিসদের। জীবাশ্ম বিজ্ঞানী লুইস লিকির মতে, হাবিলিসরা পাথরের সাথে সাথে জীবজন্তুর হাড় দিয়েও হাতিয়ার বানানো শুরু করেছিলো। মূলত পিথেকাস বা হাবিলিসরা একটু গোলাকৃতির পাথরগুলো অন্য পাথরের সাথে আঘাত করে ভেঙে ফেলতো। ফলে পাথরের ভাঙা অংশ অনেক বেশি সুঁচালো এবং ধারালো ছুরির ন্যায় ব্যবহার করা যেতো। এইধরনের অস্ত্রকে বলা হয় ওল্ডোয়ান অস্ত্র। প্রায় ১.৭-২.৯ মিলিয়ন বছর আগের সময়কালে এসকল ওল্ডোয়ান অস্ত্র ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে, হোমো হাবিলিসদের বংশধর হোমো আর্গাস্টাররা পাথর কেটে কেটে আরও উন্নত, ভয়ংকর রকম অস্ত্র বানানো শুরু করে। হাবিলিসরা যেখানে হাড় থেকে মজ্জা সংগ্রহ আর ছোটোখাটো শিকারে অস্ত্র ব্যবহার করতো সেখানে আর্গাস্টাররা রীতিমতো অস্ত্র ব্যবহারে নিপুণ সৈন্য হয়ে ওঠে। গাছপালা থেকে কাঠ কাটা, বড় বড় শিকার, মাংস কাটা, হিংস্র প্রাণীকে পাল্টা আক্রমণ করে আত্মরক্ষা- সবকিছুতেই মহারথী ওঠে তারা।


কাঁচা মাংস ভক্ষণের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ফুড পয়জনিং। কাঁচা মাংসে তুলনামূলক ব্যাকটেরিয়া অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। মাংসাশী হিসেবে বিবর্তিত হওয়া প্রাণীদের পাকস্থলীর অ্যাসিড আমাদের পাকস্থরীর তুলনায় কমপক্ষে দশগুণ বেশি শক্তিশালী হওয়ায় তাদের শরীর এসব অ্যাসিড সহজে ধ্বংস করতে পারে। উপরন্তু, তারা শিকার করেই সাথে সাথে ভক্ষণ করে বলে মাংসে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা থাকে নগণ্য। এর একটা বড় উদাহরণ ইথোপিয়ানরা। ইথোপিয়ায় এখনো মানুষ কাঁচা গরুর মাংস ভক্ষণ করে। ফলে প্রতিবছর প্রায় ৪,০০,০০০ মানুষ ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং ১৯০ জন মানুষ মারাও যেয়ে থাকে। তারা যথেষ্ট সচেতনতার সাথে মাংস প্রসেস করলেও কাঁচা খাওয়ার দরুণ এই সমস্যায় ভুগতে হয় তাদের। আবার জার্মানরা সচরাচর শূকরের কাঁচা মাংস লবণ এবং মরিচ দিয়ে খেয়ে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে yersiniosis, salmonella and Campylobacter coli এই তিন ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন অনেজ বেশি দেখা যায়।


সরাসরি শিকার করে ভক্ষণ করলে রোগের সম্ভাবনা কম হয় যদিও কিন্তু উপরে যে দাঁতের কথা বললাম, এই দাঁতের কারণে আমরা সরাসরি শিকার করেই খেতে বসতে পারিনা। আমাদের আগে প্রসেস করা লাগে, ছোট ছোট টুকরা করা লাগে। অনেক বেশি সময় লাগে এসবে। শিকারের পর খেতে যত দেরী হয় মাংসে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাও তত বেড়ে যায়। এমন না এই খাদ্য বিষাক্ততার সমস্যা আমাদের পূর্বপুরুষদের হয়নি। হয়েছিলো বলেই রান্নার মতো এক অভিনব পদ্ধতির উত্থান ঘটে পরবর্তীতে। আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং রান্নার উৎপত্তির পরে বলা চলে, মাংস ভক্ষণে এক নতুন জোয়ার এসেছিলো। সে আসলে এক আলাদা গল্প। রান্না কীভাবে আজকের মানুষকে মানুষ বানিয়েছে তা নাহয় আরেকদিন বলা যাবে।


অনেকেই ভাবেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কাঁচা মাংস ভক্ষণ করতে পারলে আমরা কেন পারবোনা? সহজ উত্তর পারবো। আমাদের পাকস্থলী এ খাদ্য হজম করতে পারবে। কিন্তু ঠিকমতো ব্যবস্থা না নিলে খাদ্য বিষাক্ততায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এরকম বহু সমস্যায় ভুগতো। এজন্য তাদের আয়ু ছিলো আমাদের থেকে অনেক কম। আপনি কী তাদের মতো অকালে মরতে চান?


পরবর্তীতে, মানুষের আয়ু দিন কমছে নাকি বাড়ছে এবং রান্না কীভাবে আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বিবর্তনে তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো আমরা। সে আলাপের অংশ হতে যুক্ত থাকুন তিকতালিকের সাথে।


লেখক: তিকতালিকীয় সদস্যবৃন্দ
কপিরাইট: তিকতালিক-Tiktaalik

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *