সৃষ্টিতত্ত্বের ক্ষুদ্রগল্প ০১ (বিগব্যাং পর্যবেক্ষণ)

সৃষ্টিতত্ত্বের ক্ষুদ্রগল্প ০১ (বিগব্যাং পর্যবেক্ষণ)

মহামান্য যখন সকালের জলখাবারের পরবর্তীতে দৈনন্দিন কাজের জন্য বাইরে যান এবং চলতি পথে হঠাৎ এক ঝলক সূর্যের দিকে উঁকি দিয়ে তাকান, তিনি তখন বর্তমান থেকে সামান্য ছিটকে অতীতে চলে যান। তিনি সূর্যকে দেখেন, সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিলে বলতে হয় তিনি সূর্যপৃষ্ঠ থেকে আগত আলোকরশ্মিকে অনুভব করেন। কিন্তু এই আলোকরশ্মি তাৎক্ষণিক সূর্যপৃষ্ঠ হতে দ্রষ্টার চোখে এসে পৌছায়নি বরং বেশ কিছুটা কালক্ষেপন করেছে নিজের চলার পথে। প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগে তার পৃথিবী এবং নিজের দুরত্ব মিটাতে। যতই দ্রুত চলুক না কেনো, আলোর বেগ তো আর অসীম নয়, কালের গন্ডিতে তাকেও থাকতে হয়!


এই যে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগে আলোর পৌছাতে, এর মর্মার্থ হলো- আমরা সূর্যের দিকে তাকালে সর্বদা ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগের সূর্যকেই দেখতে পাবো। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে প্রজ্জ্বলিত তারাদের আলোকসজ্জা যখন আমরা দেখি তখন আমরা আরও অতীত পর্যবেক্ষণ করি। কারণ এসব তারাদের দুরত্ব আরও অনেক বেশি। এদের থেকে আলো এসে পৌছাতে কয়েকশত, হাজার, লক্ষ বছর অবদি লেগে যায়। অর্থাৎ আমরা ঠিক তত বছর আগেকার আলো তথা আলোক উৎসকে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের পরে সবচেয়ে নিকটবর্তী তারকা আমাদের প্রক্সিমা সেঞ্চুরি, এর পৃষ্ঠ হতে উৎপন্ন আলো আমাদের চোখে পৌছুতে সময় লাগে চার বছরেরও অধিক। আমরা যখন প্রক্সিমা সেঞ্চুরির দিকে তাকাই তখন আমরা চার বছর পুরাতন প্রক্সিমাকে দেখতে পাই। ঠিক এই মুহুর্তে কোনো দৈববলে প্রক্সিমাকে ধ্বংস করা হলেও আমরা সেটা জানতে পারবো আজ থেকে চার বছর পরে! অতীতে বাস করাই আমাদের নিয়তি।


প্রশ্ন থেকে যায় এখানে- যত দূরের নক্ষত্রের দিকে আমরা তাকাবো ঠিক তত বেশি অতীত আমরা পর্যবেক্ষণে সক্ষম হবো। তবে কি এভাবে একদম মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন দেখা সম্ভব? আমাদের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৩৭৮ কোটি বছর। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন দেখতে হলে আমাদের ১৩৭৮ কোটি আলোকবর্ষ দূরে তাকাতে। এ তো এমন অসম্ভব কিছুই না, হাবল টেলিস্কোপ দিয়েই আমরা হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে দেখতে সক্ষম হয়েছি, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের কেরামতি দেখানো তো এখনো বাকি। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি আরও উন্নত টেলিস্কোপ উপহার দেবে আমাদের যা দিয়ে খুব সহজেই আমরা ১৩৭৮ কোটি আলোকবর্ষ দূরের একদম সুস্পষ্ট ছবি তুলতে পারবো। আমাদের এই মহাবিশ্ব শূণ্য থেকে কীভাবে শুরু হলো তা চা’য়ের সাথে বসে পর্যবেক্ষণ করা আর অসম্ভব কী?


এখানেই প্রকৃতি আমাদের বাজিমাত করে চলে গেলো। প্রকৃতি আমাদের সক্ষমতা এবং এই মহাবিশ্বের সূচনালগ্নের দৃশ্যের মধ্যে প্লাজমার এক অন্তরাল তৈরী করলো। আসলে সৃষ্টির সময় মহাবিশ্ব ছিলো অত্যন্ত গরম, প্রচুর শক্তি বন্দি ছিলো ছোট্ট আয়তনে। ধীরে ধীরে মহাবিশ্ব প্রসারিত হলো, সাথে সাথে ঠান্ডাও হতে থাকলো। মহাবিশ্বের বয়স যখন তিন লক্ষ বছর তখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা নেমে গেলো ৩০০০ কেলভিনে। এসময় শক্তির বিকিরণ ছিলো অত্যন্ত প্রখর, অণু-পরমাণু তখনও গঠিত হয়নি। সব নিউক্লিয়াস, ইলেক্ট্রন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অত্যন্ত ঘনীভূত হয়ে ছিলো। এই অত্যন্ত ঘনীভূত আধানকেই বলা হয় প্লাজমা। এই প্লাজমাই সমস্ত আলোর বিকিরণ শোষণ করে নেয়। এটা পদার্থের সাধারণ ধর্ম। কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে আলো চলার সময় আলো ওই পদার্থ দ্বারা শোষিত হয় আবার পরমুহুর্তে বিকিরিত হয়। এভাবে বারবার, বারবার শোষণ-বিকিরণের মাধ্যমে আলো কাঙ্ক্ষিত দুরত্ব অতিক্রমে সক্ষম হয়। যেহেতু, একসময় সমগ্র মহাবিশ্ব কানায় কানায় প্লাজমা দ্বারা পূর্ণ ছিলো তাই খুব সহজেই অনুমান করা যায়, মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে সৃষ্ট সব আলোই এই প্লাজমার মধ্যে দিয়ে বারবার শোষিত বিকিরিত হয়েছে। আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাতে সক্ষমও হই, আমাদের দৃষ্টিসীমা ওই প্লাজমা অবদি। তার পিছনের অতীত আমরা আর দেখতে পাবোনা। এই প্লাজমাকে বলা হয়, “Last Scattering Surface”, অর্থাৎ যে পৃষ্ঠ হতে সব থেকে পুরাতন আলোকতরঙ্গ শেষবারের মতো নিঃসৃত হয়েছে। শেষ একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে যাই- মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে উৎপন্ন আলো কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে শনাক্ত করে ফেলেছি, এবং সেখান থেকে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন তথ্যও উদঘাটন করেছি। এই আলোর নাম CMBR (Cosmic Microwave Background Radiation)। কিন্তু যতই যা করিনা কেনো আমরা, এই আলো আমাদের শেষমেশ ওই তিন লক্ষ বছর বয়সী মহাবিশ্বকেই দেখাবে, একদম সৃষ্টিরত অবস্থা না!

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *