মিষ্টির স্বাদঃ আশীর্বাদ থেকে অভিশাপ

মিষ্টির স্বাদঃ আশীর্বাদ থেকে অভিশাপ

মিষ্টির স্বাদ নিঃসন্দেহে আমাদের জীবদ্দশায় পাওয়া সবরকম সুখানুভূতিগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি অনুভূতি। কোনোরকম মিষ্টি খাদ্যই খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ সম্ভবত আতশ কাঁচ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন অনেকে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের জন্য এড়িয়ে চলেন, অনেকে আবার স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য কিংবা ডায়াবেটিকস জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মিষ্টি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু মিষ্টি খাওয়ার মনোবাসনা জাগেনা কিংবা একেবারেই সবধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার ছেড়ে থাকতে পারেন এমনটা হওয়া বাস্তবে খুবই মুশকিল। “আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো আমরাও কাঁচা মাংস ভক্ষণ করিনা কেনো?” শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধে আমরা ড্যানিয়েল লিবারম্যানকে চিনেছিলাম। লিবারম্যান একজন জীববিজ্ঞানী এবং গবেষক যিনি ছাগলের কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেয়েছিলেন শুধুমাত্র এটা অনুধাবন করার জন্য এবং করানোর জন্য যে আমাদের অভিযোজন কখনোই কাঁচা মাংস খাওয়ার জন্য হয়নি। আমাদের দাঁতের গঠন মাংসাশী প্রাণীদের দাঁতের গঠন অপেক্ষা ভিন্ন হওয়ায়, আমরা সরাসরি কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতে অভ্যস্ত নই না কখনো ছিলাম। যাহোক, এই নিয়ে উক্ত প্রবন্ধে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে, আজকের প্রবন্ধ শুরু করার জন্য আমরা লিবারম্যানের অন্য একটি উক্তির সাহায্য নিবো। তিনি তার ‘The Story the Human Body: Evolution, Health, and Disease’ বইটিতে লিখেছেন, “মিষ্টি জাতীয় খাদ্যগ্রহণ মানুষের অন্যতম গভীর এবং প্রাচীন আকাঙ্ক্ষাগুলির একটি।” মানুষ জন্মগতভাবে কেনো মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের প্রতি একটু বেশিই আকর্ষণবোধ করে সেটা বোঝানোর জন্য মূলত তিনি এই উক্তিটি করেছিলেন। মিষ্টিজাতীয় খাদ্যগুলির খুব সামান্য পরিমাণ আমাদের অনেক বেশি শক্তির জোগান দিতে পারে, ফলশ্রুতিতে অতীত ইতিহাসে এই মিষ্টিজাতীয় খাদ্যই দুর্ভিক্ষ এবং দুর্যোগের সময় আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনদাতা হয়ে এসে তাদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলো।


চিনি বা যেকোনো মিষ্টিতে প্রধান রাসায়নিক উপাদান হিসেবে থাকে সুক্রোজ, পরিপাকের মাধ্যমে আমাদের শরীরে শোষিত হওয়ার সময় সুক্রোজ ভেঙে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজে পরিণত হয়। এই ফ্রুক্টোজই আমাদের শরীরে মেদরূপে অতিরিক্ত শক্তি জমা করে রাখে যেনো আমরা বিপদে আপদে সেই মজুদকৃত শক্তি খরচ করে বেঁচে থাকতে পারি। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড জোহানসনের ভাষ্যমতে, দেড় কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী বরফযুগ উপভোগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো তখন বৈশ্বিক জলবায়ুতে বিশাল পরিবর্তন শুরু হয়, যেকোনো বৈশ্বিক পরিবর্তনে প্রথম যে বিষয়টা প্রাণীকুলকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় তা হলো খাদ্যাভাব। সেসময় এই খাদ্যাভাব থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাঁচিয়েছিলো মিষ্টিজাতীয় খাদ্য বিশষত বিভিন্ন ফলমূল। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কিছু সদস্যের শরীরে এমন একধরনের জেনেটিক মিউটেশনের অস্তিত্ব ধারণা করা যায় যেটা তাদের মধ্যে মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের প্রতি অন্যরকম চাহিদা সৃষ্টির পাশাপাশি শরীরকে ফ্রুক্টোজ সেনসেটিভ করেছিলো। ফলে ফ্রুক্টোজ রয়েছে এমন কোনো খাবার খেলেই সামান্য পরিমাণে হলেও সেটা মেদরূপে তাদের শরীরে জমা হতো যা গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের বেলায় হতো না। দীর্ঘক্ষণ খাবারের অভাবে যখন বাকী সদস্যরা মারা পড়তো ঠিক তখনই এই মেদওয়ালা প্রাণীগুলো নিজের শরীরে সঞ্চিত মেদ শক্তিতে রূপান্তরিত করে বেঁচে থাকতো অনায়াসে। এসব সদস্যদের গড় আয়ু বেশি হওয়ায় বেঁচে থাকার পাশাপাশি সন্তান রেখে যাওয়ার সুযোগও তাদের কাছেই বেশি ছিলো। সেসময় সবজি জাতীয় খাদ্য প্রচুর পাওয়া যেতো, যেখানে মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের উৎস তথা গাছপাকা ফলমূল ছিলো বেশ দুর্লভ। সবজি জাতীয় খাদ্যে শক্তির পরিমাণ ফলমূল অপেক্ষা যথেষ্ট কম। ফলে যারা মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের প্রতি প্রাকৃতিকভাবে টান অনুভব করতো শুধু তারাই এগুলো খুঁজে খুঁজে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো। এভাবে ফ্রুক্টোজ সেনসিটিভিটির জন্য দায়ী জেনেটিক মিউটেশনওয়ালা সদস্যসংখ্যা গোষ্ঠীতে বাড়তে থাকলো এবং দীর্ঘদিন যাবৎ বরফ যুগের প্রভাব প্রাণীকুলে বজায় থাকায় গোষ্ঠীতে শুধু সেই সদস্যরাই টিকে থাকলো যারা মিষ্টিজাতীয় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে স্বীয় শরীরে মেদরূপে শক্তি জমা রাখতে পারে। ড্যানিয়েল লিবারম্যান ইতিহাসের এই পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে কৌতুক করে বলেছেন, “একবার ভাবুন, সেসময় কেউ যদি বলতো আমি মিষ্টি খাইনা, মিষ্টি খেতে পছন্দ করিনা!” উল্লেখ্য, দুর্ভিক্ষের সেই দিনগুলোতে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য জীবনরক্ষাকারী হিসেবে এগিয়ে আসায় এটা আমাদের মস্তিষ্কের অভিযোজনেও সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। এইসব খাদ্যকে আমাদের মস্তিষ্ক এখন পুরষ্কার হিসেবে শনাক্ত করে থাকে এবং আমরা যখনই এইধরনের খাদ্য খাই মস্তিষ্ক থেকে সুখানুভূতি উদ্রেককারী রাসায়নিক ‘ডোপামিন’ নিঃসৃত হয় যা ক্লান্তি, সাময়িক বেদনা দূর করে মনকে ফুরফুরে করতে পারদর্শী। এটা একটা অন্যতম প্রধান কারণ মিষ্টির প্রতি আমাদের লোভাতুর দৃষ্টির। এজন্য অনেক বিশেষজ্ঞ মিষ্টিকে ড্রাগের সাথেও তুলনা দিয়ে থাকেন, যদিও সেটা আসলে অনেকাংশেই অযৌক্তিক।


মিষ্টির প্রতি ভালোবাসা যখন জন্মেছিলো তখন এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসলেও আজকের দিনে এসে মিষ্টান্ন বা যেকোনো মিষ্টিজাত দ্রব্যকে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য একপ্রকার অভিশাপ বলতে তেমন দ্বিধা নেই। অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি আমাদের স্থূলতার অন্যতম কারণ। অন্যান্য শর্করা জাতীয় খাদ্যে যেখানে প্রধানত গ্লুকোজ থাকে, সেখানে মিষ্টি জাতীয় খাদ্যে থাকে ফ্রুক্টোজ এবং চিনিতে থাকে সুক্রোজ যা ভেঙে আবার ওই ফ্রুক্টোজেই পরিণত হয়। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ গ্রহণ আমাদের শরীরে থাকা লেপটিন হরমোনকে সাময়িক অকার্যকর করে থাকে। লেপটিন আমাদের খাদ্যগ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এটা আমাদের জানান দেয় কখন আমরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেয়ে ফেলছি এবং কখন আমাদের খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়া উচিত। এই হরমোন অকার্যকর হওয়ার দরুণ আমাদের খাদ্য গ্রহণের চাহিদা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, আমরা তুলনামূলক বেশি বেশি খাদ্য গ্রহণ করে ফেলি যা থেকেই স্থূলতার সৃষ্টি। এই স্থূলতাই টাইপ-২ ডায়াবেটিকসের জন্য দায়ী। আবার মিষ্টিজাতীয় খাদ্য ক্রনিক প্রদাহ সৃষ্টি করে যার প্রভাবে একই সাথে বিভিন্ন অস্থিসংযোগে ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণা, আর্থ্রাইটিস, শ্বাসকষ্ট এবং কিছু ধরণের ক্যান্সারও সৃষ্টি হয়। রক্তে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে তা আমাদের যকৃত এবং হৃৎপিন্ডের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। মূলত যকৃতেই ফ্রুক্টোজ ভেঙে চর্বিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে যকৃতে অতিরিক্ত পরিমাণে চর্বি জমা হতে পারে যা ফ্যাটি লিভার ডিজিজ নামে পরিচিত। এর ফলে অনেক সময় যকৃতে ঠিকমতো রক্ত সঞ্চালন হয়না, তখন যকৃত প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না। আবার, অগ্ন্যাশয়তে থাকা বিটা কোষ রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপাদন করে থাকে। অনেক বেশি পরিমাণে চিনি বা মিষ্টি খাদ্য গ্রহণ করলে অগ্ন্যাশয় হতে ইনসুলিন উৎপন্নের হারও অনেক বেড়ে যায়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে থাকা ধমনীর পৃষ্ঠদেশে প্রদাহের সৃষ্টি হয়, চর্বি জমা হয়ে ধমনীগাত্র আরও পুরু হয়ে ওঠে যা হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহকে বাঁধাগ্রস্ত করে থাকে। ফলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল কিংবা স্ট্রোকের মতো ঘটনার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।


একসময়ের আশীর্বাদ আজকের যুগে এসে অভিশাপে পরিণত হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, সেসময় মিষ্টি বলতে শুধু গাছপাঁকা ফলমূলই পাওয়া যেতো যা রসগোল্লা, চমচম, জিলাপি কিংবা অন্যান্য দুগ্ধজাত মিষ্টান্নের মতো ছিলোনা। একটা উদাহরণ দিই। হলদিরামের প্রতি ১০০ গ্রাম রসগোল্লায় প্রায় ৫৮ গ্রাম শর্করা (সুক্রোজ), ১.২ গ্রাম চর্বি, ৮.৫ গ্রাম মতো প্রোটিন থাকে। এই হিসাব ব্রান্ড এবং মিষ্টির দোকানভেদে অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন। এবার একটু ফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে- ১০০ গ্রাম পাঁকা পেঁপেতে প্রায় ৭-১১ গ্রাম শর্করা, ৮ গ্রাম চিনি, ০.৫-০.৬ গ্রাম প্রোটিন থাকে। ১০০ গ্রাম গাজরের ক্ষেত্রে ৮ গ্রাম শর্করা (যার মধ্যে ৩.৫ গ্রাম চিনি), ১ গ্রাম মতো প্রোটিন থাকে। লিবারম্যানের মতে, আমাদের পূর্বপুরুষরা সেসময় মধু ব্যতীত অন্য যেসকল ফল বা খাদ্য খেতো তাতে মিষ্টির পরিমাণ আজকের দিনে আমরা যে গাজর খাই তা অপেক্ষা বেশি হবেনা বরং কমই হবে। দ্বিতীয়ত, সেসময় এই খাদ্যের জোগান আজকের মতো এত বেশিও ছিলো না। দিনে কয়েক টুকরা ফলও ঠিকমতো জুটতো না তাদের। কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার উত্থানের পর হরেকরকম ফলচাষ শুরু হয় এবং ফলের অভাবও মিটতে থাকে। তৃতীয়ত, অলসতা। কৃষিভিত্তিক সমাজে ফলের অপ্রতুলতা আর না থাকলেও সে সমাজের সদস্যরা ছিলো অত্যন্ত কর্মঠ, তাদের সম্পূর্ণ দৈনিক কার্যক্রমই ছিল কায়িক পরিশ্রম নির্ভর। ফলে তারা যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতো, তার বেশিরভাগই বিভিন্ন কাজে ব্যয় হয়ে যেতো এবং খুব সামান্য পরিমাণ শরীরে মেদ হিসেবে জমা থাকতো। আজকের দিনে, বিশেষত শিল্প বিপ্লব এবং প্রযুক্তির যুগ শুরু হওয়ার পরবর্তীকালে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের পরিশ্রমের অনেকাংশই মানসিক পরিশ্রমে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিক শ্রেণী ব্যতীত বাকি সকল শ্রেণীর মানুষ নিজেদের কার্যক্রমে কায়িক শ্রমকে এড়িয়ে চলেন। ফলে আমাদের খাদ্যে থাকা শর্করা এবং চর্বি খুব বেশি খরচ হয় না এবং শরীরে মেদরূপে সঞ্চিত হতে থাকে। এছাড়া, বর্তমানে যেসব প্রক্রিয়াজাতকৃত মিষ্টান্ন পাওয়া যায় যাতে অনেক বেশি শর্করা এবং চিনি থাকে। সফট ড্রিংকস এবং অন্যান্য প্যাকেটজাত খাদ্যেও প্রচুর শর্করা-চিনি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক চিনির বদলে কৃত্রিম চিনিও ব্যবহৃত হয়। উপরে ইতিমধ্যে আমরা রসগোল্লায় থাকা চিনির পরিমাণ জেনেছি। এই চিনির পরিমাণ প্রাগৈতিহাসিক সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে ফলমূল খেতো তার তুলনায় কমপক্ষে ৭ গুণ বেশি! চতুর্থত, অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া। বাঙালী হওয়ার দরুণ আমরা জানি মিষ্টি খেতে বসলে আমরা এক বসায় ৩০০-৪০০ গ্রাম মিষ্টি খেয়েই ফেলি (স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিবর্গ বাদে)। আবার, কায়িক শ্রম কমে আসায় এই মিষ্টিতে থাকা শক্তিও খরচ হয়না। ফলাফল, স্থূলতা এবং উপরে উল্লিখিত সকল স্বাস্থ্যঝুঁকি, অকাল মৃত্যু।


আজকের দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেককেই নো সুগার ডায়েট অনুসরণ করতে দেখা যায়, এর আরেক নাম সুগার ডেটক্স। এই নো সুগার ডায়েটে তারা প্রায় সকল ধরনের প্রক্রিয়াজাতকৃত মিষ্টান্ন, চিনি কিংবা চিনি থাকে এমন সকল প্রকার খাদ্য-পানীয় বর্জন করে থাকে। অবশ্যই এটা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভালো কিন্তু এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছিলাম মিষ্টি জাতীয় খাদ্য আমাদের মস্তিষ্ক হতে নিঃসৃত ডোপামিনের উপর সরাসরি প্রভাব রাখতে সক্ষম। এই ডোপামিন নিঃসরণের ফলে যেমন আমাদের মন ভালো থাকে তেমন ডোপামিন এর অভাব আমাদের ডিপ্রেশনের অনুভূতির জোগান দেয়। ফলে আমরা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ এবং বেদনা অনুভব করে থাকি। নো সুগার ডায়েটে মিষ্টি একদমই না খেলে এই সমস্যা তীব্রভাবে সৃষ্টি হতে পারে। একই সাথে নার্ভাসনেস, অ্যাংজাইটি, নির্ঘুমতার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে একদমই চিনি কিংবা মিষ্টি না খাওয়ার ফলে তারা পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সহজ কাজও তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় মিষ্টি জাতীয় খাদ্য জীবন থেকে বাদ দেওয়ার পরে তাদের অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যের (চিপস, ড্রিংকস, পাস্তা, নুডুলস) প্রভৃতি প্রতি চাহিদা বেড়ে গেছে যা শরীরের জন্য সমান ক্ষতিকর। এজন্য স্বাস্থ্যরক্ষায় সম্পূর্ণরূপে চিনি কিংবা মিষ্টি ত্যাগ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং এমন ভাবে খাদ্য খাওয়া উচিত যেন চিনি বা চর্বির পরিমাণ খুব বেশি বা খুব কম না হয়। এক্ষেত্রে নিয়মিত ফলমূল খাওয়া যায় আবার মিষ্টান্ন সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা যায়। পরিমাণমতো ফলমূল খেয়েই শরীরের প্রয়োজনীয় চিনি কিংবা মিষ্টির যোগান দেওয়া সম্ভব।


বাজারে চিনির পরিবর্তে এমন কিছু দ্রব্য পাওয়া যায় যা চা কিংবা কফিতে চিনির মতোই মিষ্টি স্বাদ আনে, এগুলোতে কোনো শর্করা বা অতিরিক্ত ক্যালরি নেই যা শরীরে জমা হয়ে স্থূলতা বাড়াবে। এগুলোকে বলা হয় লো ক্যালরি সুইটনার। হেলথলাইনে এমন কিছু সুইটনারের কথা উল্লেখ রয়েছে যেগুলো চিকিৎসকরা চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন:


স্টিভিয়া : Stevia rebaudiana নামক গাছের পাতা হতে তৈরী হয়। স্টিভিয়াতে থাকা স্টিভিওসাইড আমাদের খাওয়া চিনি অপেক্ষা ২৫০-৩০০ গুণ মিষ্টিস্বাদের অনুভূতি প্রদান করলেও এতে কোনো ক্যালরি নাই।


এরিথ্রিটল : বিভিন্ন ফল হতে এটি তৈরী করা যায়। খাওয়ার পরে এটি ক্ষুদ্রান্ত্রে শোষিত হয়ে যায় এবং অপরিবর্তিত অবস্থায় মূত্রের সাথে বেড়িয়ে আসে। তাই এরিথ্রিটল হতে কোনো ক্যালরি আমাদের শরীর পায়না।


জাইলিটল : এটা এক ধরনের মিষ্টি স্বাদযুক্ত অ্যালকোহল। এই জাইলিটল থেকেও আমাদের শরীর কোনো ক্যালরি পায়না। বরং এটা আমাদের অস্থি ঘনত্ব বাড়িয়ে অস্টিওপোরেসিস জাতীয় রোগ প্রতিরোধ করে। তবে জাইলিটল কুকুরের জন্য উচ্চ মাত্রার বিষের মতো কাজ করে তাই তাদের নাগাল হতে এই জিনিস দূরে রাখবেন।


বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় লো ক্যালরি সুইটনার হলো জিরোক্যাল। এই জিরোক্যাল তৈরীতে ব্যবহৃত হয় সুক্রালোজ যা একটি কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১০ টি ভিন্ন গবেষণার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে দেখে এই সুক্রালোজের কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। তাই জিরোক্যালকে আমরা সহজেই দৈনন্দিন জীবনে চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করতেই পারি। এটি চিনির থেকেও প্রায় ৬০০ গুণ বেশি মিষ্টি। তবে বর্তমানে জিরোক্যালে স্টিভিয়া ব্যবহারের প্রচলনও শুরু হয়েছে।


সফট ড্রিংকসের বদলে বাজারে ডায়েট কোক কিংবা নো সুগার কোকের মতো ড্রিংকসও পাওয়া যায়। এসব ডায়েট কোকে চিনির বদলে অ্যাসপার্টেম নামে এক ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিক সুইটনার ব্যবহার করা হয়। এটা চিনির থেকেও প্রায় ২০০ গুণ বেশি মিষ্টি কিন্তু নন-স্যাকারাইড। অর্থাৎ এতে কোনো শর্করা নেই যা অতিরিক্ত ক্যালরি প্রদান করবে কিংবা মেদরূপে শরীরে জমা হবে। তবে আমেরিকান মাইগ্রেন ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুসারে অনেকের ক্ষেত্রে এই অ্যাসপার্টেম সামান্য মাথাব্যথা সৃষ্টি করলেও করতে পারে। তাই অবশ্যই কোনো পেশাদার পুষ্টিবিদের থেকে পরামর্শ নিয়েই নিজের খাদ্যতালিকা নির্বাচন করবেন, কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে চিকিৎসককে জানাবেন। কারণ, স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে জীবনযাপন করা যতটা সহজ, স্বাস্থ্য সবল রেখে জীবনযাপন ঠিক ততটাই কঠিন। আশা করি তিকতালিকের আজকের এই প্রবন্ধটি আপনাদের উপকারে আসবে। কোনো প্রশ্ন থাকলে জানাতে দ্বিধাবোধ করবেন না। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *