মানুষের গল্প ২ঃ রান্নার উৎপত্তি

মানুষের গল্প ২ঃ রান্নার উৎপত্তি

কখন, কোথায়, কীভাবে?

মাংস খাওয়া শুরুর ইতিহাস কেমন ছিলো তা আমরা গত পর্বে আলাপ করেছিলাম। দেখেছিলাম, আমরা (আমাদের পূর্বপুরুষেরা) ছিলাম প্রধানত শাকাহারী, ফলাহারী৷ ফল, বাদাম, পাতা, মূল, বীজ এসবই ছিলো প্রধান খাদ্য। তবে এসবের সাথে নানান জাতের পোকামাকড়ও আমাদের খাদ্যতালিকায় সসম্মানে ছিলো। কিন্তু এসব খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং ক্যালরি পেতে তাদের প্রায় সারাদিনই একটু সময় পর পর খাওয়া লাগতো। এই সমস্যার সমাধানের জন্য দুইটা ঘটনা ঘটে।


১। আমাদের পূর্বপুরুষরা নেকড়ে এবং অন্যান্য হিংস্র মাংসাশী শিকারীদের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে থাকে। প্রথম প্রথম শুধু অস্থিমজ্জাই খেতো তারা। অস্থি থেকে অস্থিমজ্জা বের করার জন্য ব্যবহার করতো পাথর। এরপর এই সূঁচালো পাথর দিয়েই পিষ্ট করে কাঁচা মাংসও খাওয়া শুরু করে তারা। এভাবেই হাতেখড়ি হয় এক সম্পূর্ণ নতুন খাদ্যাভ্যাসের। আর আমাদের যে পূর্বপুরুষ শাকাহারী থেকে মাংসাহারী হয়ে ওঠে তার নাম অস্ট্রালোপিথেকাস। উল্লেখ্য, অস্ট্রালোপিথেকাস প্রথম মাংস খাওয়া শুরু করে মানে এমন নয় যে এদের সব গোষ্ঠী কিংবা গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্য মাংস খেতো। কিছু স্থানের অস্ট্রালোপিথেকাসের মাংশাসী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় শুধু।


২। নিয়মিত আগুন ব্যবহারের শুরুর সাথে সাথে বিবর্তনে রান্নার আবির্ভাব ঘটে। গত পর্বে আমরা দেখেছিলাম মাংস আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যতালিকায় না থাকার সবচেয়ে বড় কারণ, এটা ঠিকমতো কর্তন কিংবা চর্বণ করে গলধঃকরণযোগ্য করার দাঁত আমাদের ছিলো না। পরে পাথর দিয়ে পিষে, কেটে খাওয়া শুরু করলেও গলধঃকরণের পর তা হজম করা কিংবা মাংস হতে সম্পূর্ণ শক্তি শরীরের কাজে লাগানো সম্ভবকর ছিলো না। এই সমস্যার সমাধানই ছিলো মাংসকে আগুনে ঝলসিয়ে, পুড়িয়ে এর স্থিতিস্থাপক, শক্ত লিগামেন্টগুলো ভাঙা। ফলে মাংস হতো নরম, চর্বণযোগ্য এবং হজমের জন্য তুলনামূলক বেশি উপযোগী৷ এবং খাদ্য গ্রহণকারীর শরীরও এর ফলে আরও দ্রুত তরতাজা, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এর বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায় খামারীদের অভিজ্ঞতা থেকে। পশুখামারে বীজ বা অন্যান্য খাবার কাঁচা না দিয়ে রান্না করে দেওয়া হলে গরু বা ভেড়ার বৃদ্ধি অনেক বেশি হয়। আবার, গরুর দুধে চর্বির পরিমাণও রান্না করা খাদ্য খাওয়ালে বেশি হয়। একইরকম দৈহিক বৃদ্ধিতে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় মাছের খামারে। রান্না সর্বপ্রথম শুরু করে আমাদের পূর্বপুরুষ এবং অস্ট্রালোপিথেকাসের উত্তরপুরুষ “হোমো ইরেক্টাস”।


এখানে পুরো গল্পে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়। মাংস বলতে তো শুরু স্থলজ প্রাণীর শরীর থেকে প্রাপ্ত পেশি বুঝায় তাতো না, জলজ প্রাণীও আছে। আমাদের পুরো গল্পে আমরা তো জলজ প্রাণীদের কথা আলাপ করতে ভুলেই গেছি। রান্নার ইতিহাসে ঢোকার আগে মাছ শিকারের বিবর্তনীয় ইতিহাসের দিকে একবার চোখ ফেরানো যাক।


২০১০ সালে “ Anthropology” জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে সবথেকে পুরাতন মাছ শিকারের প্রমাণ তুলে ধরা হয়। এখানে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে প্রাপ্ত সেসব প্রাণীদের হাড়গোড় আবিষ্কারের কথা বলা হয়েছে যারা মনুষ্য শিকারে পরিণত হয়েছিলো। এসকল হাড়গোড় প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগেকার সময়ের। এসব হাড়গোড়ের মধ্যে বিভিন্ন স্থলজ প্রাণীর সাথে সাথে কচ্ছপ, কুমির এবং বিভিন্ন ধরনের মাগুর জাতীয় (Catfish) মাছের অবশিষ্ট কঙ্কালের অস্তিত্বও ছিলো। ২ মিলিয়ন বছর আগেকার সময়ে আমাদের যে পূর্বপুরুষ পৃথিবীতে রাজত্ব বিস্তার করছিলে সে আর কেউ নয়, প্রথম শিকার উপযোগী অস্ত্র তৈরীর কৃতিত্বধারী মহান “হোমো ইরেক্টাস”। ২০১০ এর গবেষণাপত্র থেকে অনুধাবন করা যায়, হোমো ইরেক্টাস কিংবা ইরেক্টাসেরও আগেকার সময় থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষ, পূর্বপুরুষদের অন্যান্য নিকটাত্মীয়রাও মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতো। যেটা আমাদের বিবর্তনের ধারায় বড় মস্তিষ্কধারী হওয়ার সম্ভাব্য কারণের একটা হতে পারে। মাছ থেকে প্রাপ্ত ফ্যাটি অ্যাসিডে থাকে ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স যা আমাদের ব্রেইনের আকার, গঠন আরও উন্নত করেছে। যাহোক, এই আলোচনা অন্য কোনোদিন অন্য কোনো গল্পে নাহয় করা যাবে।


বর্তমান ইসরায়েলের উত্তরে অবস্থিত জর্ডান উপত্যকায় প্রায় ০.৭৮ মিলিয়ন বছরের আশেপাশে হোমো ইরেক্টাসের বসবাস শনাক্ত করা যায়। এসকল ইরেক্টাসরা অশ্যুলিয়ান (Acheulean) সংস্কৃতির, অর্থাৎ এদের কাছে বিভিন্ন ধরনের অশ্যুলিয়ান অস্ত্র ছিলো। বোঝার সুবিধার্থে বলি, আগের প্রবন্ধে যে ওল্ডোয়ান অস্ত্রের কথা লিখেছিলাম, সেই ওল্ডোয়ান অস্ত্র থেকে বিবর্তিত এবং উন্নত হয়ে আসছে অশ্যুলিয়ান অস্ত্র। অশ্যুলিয়ান অস্ত্র মূলত “কাঁচা মাংস খাওয়ার ইতিহাস” প্রবন্ধে আলোচিত ওল্ডোয়ান অস্ত্রের বিবর্তিত ও উন্নত রূপ। গোলাকার কিংবা নাশপাতি আকৃতির এক ধার বা দুইধার বিশিষ্ট বিভিন্ন হাতকুঠারের সমারোহ এই অশ্যুলিয়ান অস্ত্রের তালিকায়। ইসরায়েলের উক্ত স্থানের ইরেক্টাসরা এসব অস্ত্র দিয়েই শিকারে নামতো। তারা বড় বড় শিকারের সাথে সাথে প্রচুর মাছও শিকার করতো। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যেটা জানতেন না সেটা হলো এসকল ইসরায়েলি ইরেক্টাসরা সবকিছু কাঁচাই খেতো নাকি রান্নার দক্ষতা অর্জন করেছিলো তারা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উক্ত স্থানে প্রাপ্ত মাছের দাঁতের ক্রিস্টাল অ্যানালাইসিস করেন গবেষকরা। গবেষণায় উঠে আসে এইসকল দাঁত যেসব মাছের সেসকল মাছ আগুনে ঝলসানো হয়েছিলো, বলা যায় রান্না করা হয়েছিলো। কারণ, দাঁতগুলো পোড়ানো হয়েছে ৫০০° সেলসিয়াসের নিচে। আগ্নেয়গিরিতে পুড়েছে এমন হলে সেটার তাপমাত্রা ৫০০° সেলসিয়াসের বেশি হতো। নিয়ন্ত্রিত আগুনেই পুড়িয়ে এগুলো খাওয়ার উপযোগী করা হয়েছে তার সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত এটা এবং এটাই প্রথম প্রমাণ যার সাহায্যে আমরা বলতে পারি, “হ্যাঁ, ইরেক্টাসরা রান্না করতে শিখেছিলো।”


দুইটা মজার তথ্য উল্লেখ করি। প্রথমত, প্রাইমেট বর্গে আমাদের বেশ দূর সম্পর্কের আত্মীয় ওরাংওটাংও কিন্তু লাঠি দিয়ে মাছ শিকার করে থাকে। অর্থাৎ আর যাই হোক, মাছ শিকার নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, অনেকেই মনে করেন অতীতে মাছ শিকার শুধুমাত্র তখনই করা হতো যখন খাদ্য সংকট হতো। এটাও অসংগতিপূর্ণ। যে হারে মাছের কঙ্কাল, অবশিষ্ট উদ্ধার হয়েছে একেক স্থানে তাতে হলফ করে বলা যায়, মাছ হোমো ইরেক্টাসদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসেরই অংশ ছিলো। উপরে উল্লিখিত জর্ডান উপতক্যাতেই প্রায় ৫০০০ মাছের কঙ্কাল পাওয়া গেছে একসাথে। ওইসময় মাছ ধরার জন্য বঁড়শির ব্যবহার ছিলোনা। লাঠি এবং পাথর মেরে মাছ ঘায়েল করা ছাড়া হাত দিয়ে মাছ ধরাটা ছিলো অন্যতম একটা জনপ্রিয় উপায় মাছ শিকারের।
যাহোক, রান্না প্রচলনের একদম শুরুর দিনগুলোতে শুধু মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হতো। বলা যায়, বার্বিকিউ ছিলো আমাদের প্রথম রান্না করা খাদ্যের আইটেম। মাংসের সাথে সাথে মাছও পুড়িয়ে খাওয়া প্রচলিত হতে থাকে। কিন্তু শাক-সবজি, ফলমূল পুড়িয়ে খাওয়া হতো কি হতোনা- এর পক্ষে-বিপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, ইরেক্টাসরা পোড়ানো ছাড়াও আরও দুইটা রান্নার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো- সিদ্ধ করা এবং বেক করা। বেক করা বলতে তারা উত্তপ্ত ছাইয়ের মধ্যে মাংস, মূল জাতীয় সবজি, বিভিন্ন ধরনের বীজ চাপা দিয়ে দিতো। ছাইয়ের উত্তাপে দীর্ঘসময় রাখার ফলে মাংসে একটা স্মোকি ফ্লেবার চলে আসতো। অপরদিকে, মাংস সিদ্ধ করার জন্য ইরেক্টাসের সময় কোন পাত্র ছিলোনা, অন্তত এখনও পর্যন্ত “ইরেক্টাসরা হাতে তৈরী পাত্র ব্যবহার করতো” এরূপ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মাংস সিদ্ধের প্রচলন সেসময় থাকলে তারজন্য হয়তো গাছের বাকল, অবতল আকৃতির পাথর পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সিদ্ধ করার সুবিধা হলো, এতে মাংস হতে চর্বি ছাড়িয়ে যায় এবং পানির ভিতর আলাদা হয়ে ভাসতে থাকে। যেখানে পোড়ানোর সময় মাংসের পৃষ্ঠতল হতে চর্বি গলে গলে পড়ে যায় এবং রান্না করা মাংসে চর্বির পরিমাণ কমে যায়। সিদ্ধ করলে যেহেতু চর্বি পানিতেই থেকে যায়, ওই পানি (চর্বির স্যুপ) পান করে চর্বির চাহিদা অল্পতেই পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে। উল্লেখ্য, মাংস পুড়িয়ে খাওয়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেলেও সিদ্ধ এবং বেক করার কোনোপ্রকার প্রমাণ পাওয়া যায় নাই, এগুলো কেবল হাইপোথিসিস মাত্র।
এরপরে মিলিয়ন বছরের সময়কালে আসলে রান্নার পদ্ধতি কিংবা রান্নার সরঞ্জামে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। বলা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষরা রান্না নিয়ে আহামরী কোনো চিন্তা-ভাবনা করেনি নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য, অন্তত উল্লেখযোগ্য কিছু এখনো পাওয়া যায়নি। বরং এসময়টাতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের শিকার সরঞ্জামে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছিলো। রান্নাবান্নায় কেনো তেমন পরিবর্তনসাধন হয়নি সে প্রশ্নের উত্তর জ্যাকব ব্রোনোওস্কি খুব সুন্দরভাবে তার “The Ascent of Man” বইতে লিখেছেন। ইরেক্টাস বা তার উত্তর-পূর্বপুরুষরা কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে বছরের পর বছর বংশপরম্পরায় বাস করতো না। বরং প্রতি মুহুর্তে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণের উপর থাকতো। যেটাকে বর্তমান বাংলা ভাষায় বলা হয় “যাযাবর”। ফলে তাদের জন্য বেশি প্রয়োজন ছিলো নিজেদের আত্মরক্ষা করা এবং শিকারের সাথে সম্পর্কিত সরঞ্জাম, পদ্ধতি, কৌশল আরও আরও উন্নত করতে থাকা। রান্নার জন্য যে পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করেছিলো (আগুনে পোড়ানো) সে পদ্ধতিই তাদের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট সহায়ক ছিলো, নতুন নতুন পদ্ধতি ভাবার প্রয়োজনীয়তা কিংবা প্রতিকূলতা আসেনি। এজন্য ওইসময়কালে রান্না সম্পর্কিত নতুন নতুন আবিষ্কারের খুব বেশি আশা রাখাও উচিত না আমাদের।


রান্নার পদ্ধতিতে পরবর্তী বড় পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায় ৩০,০০০ বছর আগে। তখন মাটি খুঁড়ে গর্ত করে সেখানে চুলা বানানো শুরু করে ইউরোপিয়ানরা। প্রথমে মাটিতে গর্ত করা হতো, এরপর নিচে পাথর দেওয়া হতো, তার উপরে থাকে গরম উত্তপ্ত কয়লা এবং ছাই, এর উপরে পাতায় মুড়িয়ে মাছ মাংস রাখা হতো। তারপর পুরো গর্তটাই মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। ঘন্টার পর ঘন্টা উত্তপ্ত কয়লার তাপে ধীরে ধীরে মাংস রান্না হতো। ধীরে ধীরে অধিক সময় নিয়ে রান্নার সুফল হলো- মাংসের কানেক্টিভ টিস্যুতে থাকা কোলাজেন ভেঙে জেলাটিনে পরিণত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যেতো। এটাই প্রথম খাদ্য তৈরীতে ‘বেক পদ্ধতি” ব্যবহার করার প্রাপ্ত প্রমাণ। উল্লেখ্য, মাটি খুঁড়ে চুলা বানানো অনেক আগেই শুরু হলেও আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখন যে মাটির চুলা ব্যবহৃত হয় তার প্রচলন এখন থেকে মাত্র ১০,০০০ বছর আগে।


এরপর আসে পাত্র ব্যবহারের যুগ। সবথেকে পুরাতন মাটির পাত্রের যে অস্তিত্ব পাওয়া গেছে সেটা প্রায় ২০,০০০ বছর আগেকার। হয়তো তার আরও আগে থেকেই বিভিন্ন পাত্র ব্যবহারের প্রচলন ছিলো। কিন্তু সেসব শুধুই “হয়তো”, ২০০০০ বছরের পূর্ববর্তী সময়ে পাত্র ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি এখনো। যাহোক, জাপান থেকে প্রাপ্ত পাত্রের অবশিষ্টাংশ থেকে গবেষকরা উদ্ধার করেছেন মাছ এবং খোলসওয়ালা মাছের শরীরে পাওয়া যায় এমন ফ্যাটি অ্যাসিড। এটাই প্রথম পানিতে সিদ্ধ করার মাধ্যমে রান্নাবান্না করার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।


বরফযুগ শেষ হওয়ার পর রান্নাবান্নায় নতুন জোয়ার দেখা যায়। তখন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিভিত্তিক সমাজের উত্থান ঘটে। ফলে মানুষ জায়গায় জায়গায় ঘুরে না বেরিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে ঘর বেঁধে, গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। নির্দিষ্ট জায়গায় চাষবাষ করে অধিক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা যায় বিধায় খাদ্য সংগ্রহের চাপ কমে আসে, হাতে অধিক সময় থাকায় রান্নাবান্নায় নতুন নতুন সৃজনশীলতাও আসতে থাকে, নতুন নতুন রেসিপির উদ্ভব ঘটে। বলে রাখা ভালো, খাদ্যে সুগন্ধ এবং ভিন্ন স্বাদ আনার জন্য গাছের পাতা এবং বীজ মশলা হিসেবে ব্যবহারও জনপ্রিয় হতে থাকে এই কৃষিভিত্তিক সমাজে, নতুন নতুন রেসিপি আবিষ্কারের তাগিদে। তবে শিকারী সমাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পাত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে একধরনের পাতার ব্যবহার শনাক্ত করা যায় যার গন্ধ, স্বাদ প্রায় রসুন-সরিষার মতোই। এ থেকে ধারণা করা হয়, কৃষিভিত্তিক সমাজে বেশি জনপ্রিয় ও প্রচলিত হলেও রান্নায় মশলার ব্যবহার আরও বহু আগেই শুরু হয়েছে, বিশেষ করে পাত্র আবিষ্কারের পর থেকেই।


এই ছিলো আজকের রান্নার আবির্ভাব এবং রন্ধন পদ্ধতি ও সরঞ্জামের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত গল্প। আপনার মনে জিজ্ঞাসা আসতে পারে, প্রথম মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে দেখার বুদ্ধি ইরেক্টাসদের মাথায় কীভাবে এসেছিলো? এর কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই, পাওয়া হয়তো সম্ভবও নয়। তবে সবথেকে সরল ধারণা হলো, প্রাকৃতিক আগুনে (আগ্নেয়গিরি, বজ্রপাত) পুড়ে মরা কোনো প্রাণী অনুসন্ধিৎসু মনে প্রথম খেয়েছিলো ইরেক্টাস বা তারও আগের পূর্বপুরুষরা। সেখান থেকেই আগুনে পুড়িয়ে খাদ্য প্রস্তুতের ধারণা আসে। পরবর্তীতে আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শেখার পর বার্বিকিউ করে মাছ মাংস খাওয়া জনপ্রিয় হতে থাকে। এই গল্প বলার সময় একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে। যেটা হলো, বিবর্তনে রান্না এমন কী ভূমিকা রাখলো যে সেটা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনবদ্য অংশ হয়ে গেছে? রান্না আমাদের ফিজিওলজি এবং অ্যানাটমিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? মূলত রান্নাই আজকের মানুষকে মানুষ করেছে। বিস্তারিত আলোচনা এবং গবেষণা আমরা আগামী পর্বে করবো। ততক্ষণের জন্য ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর তিকতালিকের সাথে থাকুন।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *