দিগন্তের কথা

দিগন্তের কথা

আমাদের মহাবিশ্ব কতদূর বিস্তৃত? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানিনা, জানা আসলে সম্ভবও না। আমরা আমাদের চারপাশে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই মহাবিশ্বকে দেখতে পাই। এই সীমার বাইরে থেকে কোনো কণা বা আলো আমাদের পর্যন্ত পৌছায় না বিধায় এই সীমার বাইরের এলাকার কোনো কিছু আমাদের পক্ষে দেখতে পাওয়া কিংবা কোনো তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব না। এই সীমা কে বলা হয় মহাজাগতিক দিগন্ত তথা কণা দিগন্ত।

আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে যা প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিলো। আমাদের মহাবিশ্বে যেকোনো বস্তুর তুলনায় আলোর বেগ সর্বাধিক, আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে কোন কিছুই চলতে পারে না, অসম্ভব। এই আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। সে হিসেবে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে যদি বিগ ব্যাং ঘটে থাকে তবে বিগ ব্যাং এর সময় সৃষ্ট আলো সর্বোচ্চ ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব অতিক্রম করার কথা। কিন্তু আমরা প্রায় ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের আলো দেখতে পাই! পৃথিবী হতে যে সীমানা অবদি আমরা আলো দেখতে পাই সেটাকে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব বলে, এটা আমাদের প্রকৃত মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র অংশ। তাহলে আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সীমানা, পৃথিবী হতে যেকোনো দিকেই ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ বলা চলে। বিগ ব্যাং এর সময় সৃষ্ট এই আলোর নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMBR), আর যে সর্বোচ্চ ৪৬ আলোকবর্ষের দুরত্ব হতে আলো আসার কথা উল্লেখ করলাম সেটাই মহাজাগতিক দিগন্ত, এটাই আমাদের মহাবিশ্বকে দেখার সীমানা।


প্রশ্ন হলো, ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাং সংঘটিত হলে আলো কিভাবে ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব অতিক্রম করছে? আলোর এই অসাধ্য সাধনের কারণ মহাবিশ্বের স্ফীতি। আমাদের মহাবিশ্ব মোটেও স্থির নয়, বরং বিগ ব্যাং হতে এটা প্রসারিত হয়েই চলেছে। এই প্রসারণ আসলে কীরকম? ধরুন, একটা ঘরে সারি দিয়ে পাঁচজন পাঁচটা চেয়ার নিয়ে বসলেন। আপনি প্রথম চেয়ারে বসা এবং প্রতিটা চেয়ারের মধ্যবর্তী দুরত্ব এক মিটার করে। হঠাৎ খেয়াল করলেন, চুপচাপ বসে থাকা সত্ত্বেও আপনারা একে অপরের থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছেন। কারণ আপনার ঘর নিজে প্রসারিত হচ্ছে, ঘরের মেঝেও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। ফলে আপনার থেকে আপনার সাথীদের দুরত্বও বেড়ে চলেছে। ধরলাম, প্রতি মিটারে মেঝের এই প্রসারণের পরিমাণ ৫ মিটার/সেকেন্ড। অর্থাৎ-


আপনার থেকে দ্বিতীয় চেয়ারে বসা সঙ্গী ৫ মিটার/সেকেন্ড বেগে দূরে যাবে।
আপনার থেকে তৃতীয় চেয়ারে বসা সঙ্গী ১০ মিটার/সেকেন্ড বেগে দূরে যাবে।
আপনার থেকে চতুর্থ চেয়ারে বসা সঙ্গী ১৫ মিটার/সেকেন্ড বেগে দূরে যাবে।
আপনার থেকে পঞ্চম চেয়ারে বসা সঙ্গী ২০ মিটার/সেকেন্ড বেগে দূরে যাবে।


যত দুরত্ব বেশি, দুরে যাওয়ার হার তত বেশি। বিষয়টা শুধু এমনই নয়, দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে দুরে যাওয়ার হারও আবার বাড়ছে। যখন দ্বিতীয় সঙ্গী ১.৫ মিটার দুরত্বে চলে যাবে তখন তার দুরে যাওয়ার হার বেড়ে হবে ৭.৫ মিটার/সেকেন্ড! ফলে আরও দ্রুত সে দূরে সরে যেতে শুরু করবে এবং সাথে সাথে প্রসারণের হারও আবার বেড়ে যেতে থাকবে। এভাবে একসময় দূরে যেতে যেতে সে এত দূরে পৌছে যাবে যে আপনি আর তাকে দেখতেই পাবেন না আপনার দৃষ্টির সীমানার বাইরে। যেমন মহাবিশ্বের সিংহভাগই এখন আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে, খুব সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এবার চিন্তা করুন, ঘরের প্রসারণ শুরুর সময় যদি দ্বিতীয় চেয়ারে বসা ব্যক্তি আপনার নিকট একটা বল নিক্ষেপ করে তবে সেটা কি আপনার নিকট পৌছাবে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে পৌছাবে না। কারণ, বস্তু ছোঁড়ার মুহুর্তে মধ্যবর্তী দুরত্ব এক মিটার হলেও ঘরের প্রসারণের ফলে এই দুরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে, অর্থাৎ বল পৌছানো সম্ভবই না! এই ধরনের উপসংহারে যদি আপনি পৌছে থাকেন তবে আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষা করছেন এখানে। ঘরের প্রসারণ কিন্তু শুধু মেঝের হচ্ছে এমন না, ঘরের মধ্যবর্তী শূণ্যস্থানেও একই প্রসারণ ঘটছে। এর অর্থ স্থান প্রসারণের প্রভাব কিন্তু ওই বস্তুর উপরেও থাকবে। ফলে বস্তু নিজের বেগে আপনার দিকে এগিয়ে আসবে, সাথে সাথে স্থানের প্রসারণও বস্তুটাকে আপনার দিকে আগিয়ে দিবে। ফলে আপনি দ্বিতীয় চেয়ার থেকে ক্রমাগত আরও দূরে সরে গেলেও ছুঁড়ে দেওয়া বস্তু আপনার অবদি পৌছাতে সক্ষম হতে পারে!


এই একইরকম কাহিনী ঘটে উপরে উল্লিখিত CMBR এর ক্ষেত্রে। বিগ ব্যাং হওয়ার পর ১৩.৮ বিলিয়ন বছর অতিক্রম হয়েছে। আলোর বেগে এতদিনে চলে সর্বোচ্চ ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দুরত্বই অতিক্রম করার কথা। সেখানে আমরা ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের থেকে আলো (CMBR) পাচ্ছি, অত দূরে থাকা গ্যালাক্সি, নেবুলার তথ্য জানছি। স্থান প্রসারণের বদৌলতেই এত দূর থেকে আলো আমাদের অবদি পৌছাতে পারে, আমরা পৃথিবী থেকে যেকোনো দিকেই সর্বোচ্চ ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ অবদি দুরত্ব দেখতে পারি। এটাকেই বলে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, আর এই সীমাকে বলে মহাজাগতিক দিগন্ত বা কণা দিগন্ত।


এত সময় যে স্থান প্রসারণের কথা বললাম এটার মান প্রতি ৩.২৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষে ৭৩ কিলোমিটার/সেকেন্ড। এই ৩.২৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দুরত্বকে সংক্ষেপে আমরা ১ মেগাপারসেক বলতে পারি। এর অর্থ কী?


১ মেগাপারসেক দুরত্বে থাকা কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৭৩ কিলোমিটার দুরে সরে যাচ্ছে।
২ মেগাপারসেক দুরত্বে থাকা কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ১৪৬ কিলোমিটার দুরে সরে যাচ্ছে।
৩ মেগাপারসেক দুরত্বে থাকা কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ২১৯ কিলোমিটার দুরে সরে যাচ্ছে।
৪ মেগাপারসেক দুরত্বে থাকা কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ২৯২ কিলোমিটার দুরে সরে যাচ্ছে।
৫ মেগাপারসেক দুরত্বে থাকা কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩৬৫ কিলোমিটার দুরে সরে যাচ্ছে।


এভাবে যত দুরত্ব বাড়বে, কোনো গ্যালাক্সি আমাদের থেকে তত দ্রুত গতিতে দুরে যাবে। এভাবে একটা দুরত্ব পরে দেখা যাবে গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিমি এর বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো আমাদের সাপেক্ষে আলোর চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল! মনে রাখতে হবে, এতে কিন্তু আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা লঙ্ঘিত হচ্ছেনা। এখানে স্থান নিজে আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে প্রসারিত হচ্ছে, কোনো বস্তু আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করছে না। যাহোক, যে সীমার বাইরে বস্তু আলোর চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল হচ্ছে বলে প্রতিপন্ন হয় সেই সীমানাকে বলে হাবল দিগন্ত।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *