জলের স্মৃতি ও পানিপড়ার বিজ্ঞান

জলের স্মৃতি ও পানিপড়ার বিজ্ঞান

এক মাঝরাতের ট্রেনে করে যাচ্ছি অন্ধ্রপ্রদেশের ভাইজ্যাক থেকে পশ্চিম বঙ্গের হাওড়ার দিকে। আমার সামনেই এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক। তামিল নাডুর ভেল্লোরে এসেছিলেন ছেলের চিকিৎসা করাতে। ছেলের বয়স ৯ কি ১০ হবে। গলায় দু’টো বড় বড় তাবিজ ঝুলছে। ভদ্রলোকের নাম তোয়াহা। ছেলেকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ায় বেশ খোশ মেজাজে আছেন। একটু পর পর আমাকে বিভিন্ন খাবার অফার করে যাচ্ছেন। তোয়াহা সাহেবের সাথে কথার একপর্যায়ে তিনি বললেন যে, তার ধারণা চিকিৎসা না যতোটা তার ছেলের ক্যান্সার সারিয়েছে তারচেয়ে বেশি উপকার করেছে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া পানিপড়া। আমি চেষ্টা করলাম সৌজন্যসূচক মৃদু হাসার। তিনি বললেন, “হাসবেন না। এই পানিপড়া ব্যাপারটা তো এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত”।


বলতে বলতেই তোয়াহা সাহেব “কষ্টিপাথর” নামে একটা বই বের করে দিলেন। সাথে আরও কিছু বই দেখে বুঝলাম তোয়াহা ভাইয়ের বই পড়ার অভ্যাস আছে। সে বইটার ২৫ নম্বর প্রবন্ধটা আমাকে পড়তে দিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম, “জীবনের অপর নাম পানি”। পড়তে পড়তে দেখলাম এই এমবিবিএস ডাক্তার এক পর্যায়ে সত্যিই পানিপড়াকে এক “বাস্তবতা” এবং “বিজ্ঞান” হিসেবে দাবী করেছেন। একই সাথে বইটির লেখক নজর লাগা ব্যাপারটাকে “প্রমাণিত” দাবি করে গালভরা আত্মবিশ্বাসে লিখেছেন, “এটাও এখন আর কুসংস্কার বলার সুযোগ নেই”।পানিপড়া, ঝার-ফুঁক, কুনজরের মতো ব্যাপারগুলিকে এক প্রকার জোর করেই “বৈজ্ঞানিক” দাবি করে বসার পেছনে যে অপবিজ্ঞানবেষ্টিত গবেষণা ছিলো, সেটা আজকের দুনিয়ায় যথেষ্ট হাস্যকর, এবং সত্যিকারের বিজ্ঞান থেকে যোজন যোজন দূরে। আমাদের আজকের আলোচনা সেই স্টাডি নিয়েই।


গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মাসারু ইমোতো নামে এক জাপানিজ ভদ্রলোক দাবি করেন যে আমাদের কথাবার্তা, সঙ্গীত, এবং ছবির উপর ভিত্তি করে পানির ক্রিস্টাল বিভিন্ন আকৃতিধারণে সক্ষম। তার মতে, পানির আবেগ আছে। পানি ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত এর তফাৎ বুঝে। তার দাবি, সুন্দর ছবি দেখলে পানির ক্রিস্টাল সুন্দর আকৃতি নেয়, আবার কুৎসিত কোনো ছবি দেখলে এলোমেলো আকৃতির ক্রিস্টাল গঠন করে। অর্থাৎ সুন্দর কথাবার্তায় (যেমন: ধন্যবাদ) সুগঠিত ক্রিস্টাল গঠিত হয়; তিরস্কার বা নেতিবাচক (তুমি পাগল, বোকাচন্দ্র) কথায় বিকৃত ক্রিস্টাল তৈরি করে। প্রার্থনা, কার্টুন এসবেও ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির সুগঠিত ক্রিস্টাল গঠিত হয়। ইমোতোর এই কাজ মেইনস্ট্রিম বিজ্ঞানমহলে কেউ আমলে না নিলেও, তার এইসব দাবি পছন্দ হয় “কোয়ান্টাম কনশাসনেস মুভমেন্ট” নামক এক অপবিজ্ঞান প্রচারকারী গোষ্ঠীর।


যাহোক, মূল আলোচনা থেকে সরে এবার কিছু প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় জানিয়ে রাখি। বৈজ্ঞানিক যেকোনো আবিষ্কার প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সেটাকে নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি, পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো জার্নালে প্রকাশের সময় সেটা অনেক কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এটাকে বলে “পিয়ার রিভিউ”। আবার পানিপড়ার মতো কোনোকিছুর গুণাবলী নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডবল ব্লাইন্ড প্রসিডিওর নামক একটা ট্রায়াল এর মধ্য দিয়ে এটাকে যেতে হয়। যেখানে র‍্যান্ডম কয়েকজন অসুস্থ ভলিন্টিয়ারকে না জানিয়ে তাদের কয়েকজনকে ওষুধ খাওয়ানো হবে এবং কয়েকজনকে খাওয়ানো হবে পানিপড়া। এক্ষেত্রে মূল গবেষকও জানবেন না কে পানিপড়া খাচ্ছে আর কে আসল ওষুধ খাচ্ছে। যদি গবেষণা শেষে দেখা যায় ওষুধের তুলনায় পানিপড়া খেয়েই বেশি মানুষ সুস্থ হয়েছে, তাহলে পানিপড়াই শ্রেয় বলে গণ্য হবে। যেহেতু এখানে ফলাফল প্রকাশের আগ অবদি গবেষক এবং ভলান্টিয়াররা কেউই জানেননা কে কোনটা খেয়েছেন, তাই এটাকে ডবল ব্লাইন্ড প্রক্রিয়া নামে অভিহিত করা হয়। একটা গবেষণার ফলাফলে পূণরাবৃত্তিযোগ্যতা না থাকলে সেটা যতো চমৎকার গবেষণাই হোক না কেন, তা বাতিল হবেই। এর কিছু উদাহরণ আপনাকে দেয়া যাক।
ফ্রেঞ্চ ইমিউনলজিস্ট জ্যাক বিনভিনিস্তে কিছু পরিমাণ অ্যান্টিবডি উচ্চ তাপমাত্রায় পানিতে মিশান। এক পর্যায়ে সেই নমুনায় আর কোনো এন্টিবডি অবশিষ্ট থাকে নি৷ এরপর তিনি দেখান যে সেই নমুনায় আর কোনো অ্যান্টিবডি না থাকা সত্ত্বেও সেখানে বেসোফিল এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় যেনো সেখানে অ্যান্টিবডি আছে। সেই ফ্রেঞ্চ গবেষক কোনোভাবে তাঁর এই গবেষণা বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল ন্যাচারে প্রকাশ করতে সমর্থ হোন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর এই গবেষণার একই ফলাফল আনতে ব্যর্থ হওয়ায়, অর্থাৎ এই কাজের পূণরাবৃত্তিযোগ্যতা না থাকায়— এই গবেষণাকে বাতিল বলে গণ্য করা হয়। এবং ন্যাচার তাদের এক সংখ্যায় এক রিপোর্টে বলে, “High-dilution experiments a delusion”। জ্যাক বিনভিনিস্তের এই একই ধারণাটি নিয়ে কিছুকাল পর নোবেলজয়ী ফ্রেঞ্চ ভাইরোলজিস্ট লুক মন্টাগনিয়ের একই গবেষণা ডিএনএ আর প্যাথজেনিক ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে চালান। ফলাফলে তিনিও এমন কিছুই দাবি করেন। দাবি একটাই, “পানি স্মৃতিধারণে সক্ষম”; কিন্তু পরবর্তীতে জ্যাক বিনভিনিয়েস্তের মতোই একই ফলাফল পুণরায় দেখাতে না পারায় এ গবেষণাও বাতিল হয়ে যায়।


এবার আসা যাক, মাসারু ইমোতোর গবেষণায়। তার গবেষণারর ফলাফলে উপরোক্ত উদাহরণগুলির মতো পূণরাবৃত্তিযোগ্যতা আছে কিনা, তা যাচাই করতে আহবান করেছিলেন বিখ্যাত অপবিজ্ঞান খন্ডনকারী জেমস র‍্যান্ডি। তাকে যথাযথ ডাবল-ব্লাইন্ড কন্ডিশনে একই ফলাফল দেখাতে আহবান করা হয়েছিলো এবং মিলিয়ন ডলার পুরষ্কারও ঘোষণা করা হয়েছিলো। ইমোতো সেখানে সারা দেন নি। “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা আমাদের এই মাসারু ইমোতো পিয়ার রিভিউড জার্নাল, ডাবল-ব্লাইন্ড প্রসিডিওর- এসব আমলে না নিয়ে নিজের খোলা প্রকাশনী থেকে “Message from Water” নামে একটি বই প্রকাশ করেন তার ফাইন্ডিংসগুলি নিয়ে। Maui News এ ধর্মতত্ত্ববিদ জন উডহাউজের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমোতো বলেন, “আমি আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে শুরু করি নি। আমি বিজ্ঞানের সীমানাটুকু জানি না বলেই আমার নিজেকে আমি এ গবেষণা নিয়ে থামানোর সুযোগ দিই নি”। এক প্রকার সরল স্বীকারোক্তি-ই বলা যায়। তার গবেষণা ঠিক কতোটুকু বিজ্ঞান নাকি এটা বিজ্ঞানের আওতাতেই পড়ে না, এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক টিভি সাক্ষাৎকারে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ইমোতো বলেন,


“It is not science. Because as long as science needs a double blind system, no new science appeared. Because.. you know, we have two eyes. Why we need to… you know, to be the double blind.”


বৈজ্ঞানিক গবেষণাপদ্ধতির ধার না ধরা এই মাসারু ইমোতোর শিক্ষাজীবনের দিকে তাকালে খ্যাতির পেছনে নিদারুণভাবে দৌড়ানো এক মানুষকে দেখতে পাবেন। জাপানের ইয়োকোহামা মিউনিসিপাল ইউনিভার্সিটি থেকে “আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে কিছু বছর পর চলে আসেন ইন্ডিয়ায়। ইন্ডিয়ার “Open International University for Alternative Medicine” নামক এক প্রতিষ্ঠান থেকে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’ নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৯২ সালে নিজের নামের পূর্বে “Dr.” ঠেসে দেন। এর কিছুদিন বাদেই প্রতিষ্ঠানটিকে টাকার বিনিময়ে হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে সনদ বিক্রির অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এই অল্টারনেটিভ মেডিসিন ব্যাপারটা যথেষ্ট বিপদজনক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে কোনো মেডিসিনের কার্যকারিতা এবং সেটার হিলিং ইফেক্ট বুঝতে বিভিন্ন মানদন্ড হতে প্রাপ্ত প্রমাণাদির ওপর নির্ভর করা হয়। কিন্তু এই অল্টারনেটিভ মেডিসিনে কোনোকিছুর তোয়াক্কা করতে হয় না। কিছুটা হোমিওপ্যাথির মতো।


রূপকথা, ফিকশন, সিউডোসায়েন্স(অপবিজ্ঞান) বরাবরই সাধারণ মানুষের পছন্দের বিষয়। ২০০৪ এ এসে মাসারু ইমোতোর বই “Message from Water” হয়ে গেলো নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার। তারপরই মোটামুটি মেইনস্ট্রিম একাডেমিয়ানদের থেকে তার কাজ নিয়ে কঠোর সমালোচনা আসতে শুরু করে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. উইলিয়াম টিলারের ভাষ্যে, “বাহ্যিক পদার্থের সাহায্যে কিংবা পানির জমাট বাঁধার হারকে প্রভাবিত করে এর ক্রিস্টাল গঠনের আকৃতি সহজেই বদলানো সম্ভব।”


এখানে পানির ক্রিস্টাল আসলে বরফকেই বলা হচ্ছে। এমন ক্রিস্টালগুলি কেন প্রতিসম এবং অধিকাংশই ষড়ভুজাকৃতির হয়, তা একটু ছোট্ট করে বলি। দু’টো হাইড্রোজেন পরমাণু তাদের একমাত্র ইলেকট্রনটাকে অক্সিজেনের বাইরের শেলের দু’টো ইলেকট্রনের সাথে শেয়ার করে সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে পানির অনু গঠন করে। অক্সিজেনের বাইরের শেলে ২ জোড়া ইলেকট্রন বন্ধনমুক্ত অবস্থায় থেকে যাওয়ায় এরা একে অপরকে বিকর্ষণ করতে থাকে। এতে করে বন্ধনে যুক্ত থাকা হাইড্রোজেন পরমাণু দুটি দুই পাশ থেকে সরিয়ে সেই চতুস্তলকটিকে বিকৃত করে V আকৃতির বানিয়ে ফেলে। এবং অণুটির হাইড্রোজেনদ্বয়ের মধ্যকার বন্ধনকোণ হয় ১০৪.৫°।


অন্যদিকে, পানির অণু সার্বিকভাবে চার্জ নিরপেক্ষ হলেও এই অণুতে পোলারাইজেশনের ফলে অক্সিজেন পরমাণু কিছুটা ঋণাত্বক আচরণ করে। আর হাইড্রোজেন পরমাণু কিছুটা ধনাত্বক আচরণ করে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, অক্সিজেনের তড়িৎ ঋণত্বকতা বা ইলেক্ট্রোনেগেটিভিটি হাইড্রোজেনের চেয়ে বেশি হওয়ায় ইলেকট্রন মেঘের ঘনত্ব অক্সিজেনের দিকেই বেশি থাকে। তরল বা বাষ্পীয় অবস্থায় সাধারণত পানির অণুগুলি বিক্ষিপ্ত প্যাটার্নে থাকলেও স্নোফ্ল্যাক বা বরফ ক্রিস্টালে রূপান্তরিত হওয়ার সময় প্রত্যেকটা পানির অণুর ঋণাত্বক আচরণ করা অক্সিজেন অংশের সাথে অন্য পানির অণুর ধনাত্বক আচরণ করা হাইড্রোজেন অংশটি যুক্ত হয় হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে। অণুদের মাঝে একে অপরের এমন বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার ফলে একটা হেক্সাগনাল প্যাটার্ন (ষড়ভুজাকৃতি) তৈরি হয়। বরফ ক্রিস্টালের হেক্সাগনাল গঠনের পেছনে মূল বিজ্ঞান এটুকুই।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর কোনো বরফ ক্রিস্টালই একটা আরেকটার সাথে আইডেন্টিকাল না। কারণ, বরফ ক্রিস্টালের আকৃতি অনেকটা নির্ভর করে বাতাসের আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রার মতো বায়ুমন্ডলীয় প্রভাবকের ওপর। এটা কখনোই লেড জ্যাপলিনের গান কিংবা পূণ্যশ্লোকের উপর নির্ভর করে না। আবহাওয়ার ছোটখাটো পরিবর্তনের কারণে একই সময়ে তৈরি হওয়া বরফ ক্রিস্টালের একে অপরের মধ্যে বিষদ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কৃত্রিমভাবে বানাতে গেলে সহজেই ক্রিস্টালের আকৃতি ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা যাবে। সেটাই উপরে বললেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. টিলার। তিনি আরও বলেন,


“In Dr. Emoto’s experiments, (supercooling) was neither controlled nor measured, a necessary requirement to be fulfilled if one wanted to prove that it was the new factor of specific human intention that was causative.”


বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী “স্কেপটিকাল ইনকুইরার” এ ইমোতোর বেস্ট সেলার হওয়া উক্ত বইটির রিভিউ লিখতে গিয়ে ডাঃ হ্যারিয়েট হল এ বইটিকে রূপকথার গল্প “এলাইস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” এর মতোই বৈজ্ঞানিক বললেন। কয়েক দশক ধরে সিউডোসায়েন্স আর হাতুড়ে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে লড়ে আসা এই চিকিৎসকের বক্তব্য, “বইটি আমার বুকশেলফে আমার পড়া আজ অবধি ‘সবচেয়ে বাজে বই’ এর খেতাবটা ধরে রেখেছে”।


পানির গঠনে স্মৃতি জমা করে রাখার মতো কোনো স্নায়ুতন্ত্র নেই। থাকা সম্ভবও না। অপবিজ্ঞানের ঝান্ডাধারীরা পরমাণুতে কনশাসনেস বা চেতনা থাকার যে গালগল্প শোনায়, সেটারও বিন্দুমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পরমাণুরা মিলে গঠিত করে অণু। একেক অণু একেক কম্বিনেশানে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় একেক জীবের দেহ। জীবের জটিল নার্ভাস সিস্টেম থেকেই আসে চেতনার ধারণা। এসব অপবিজ্ঞান শুনতে হয়তো বেশ চমৎকার লাগে, কিন্তু বাস্তবে এগুলি রূপকথার চেয়েও বেশি অসম্ভাব্যতা ধরে রাখে। ভদ্রলোক তার বই-টই প্রকাশের অনেক পরে ২০০৮ সালে ছুটে গেলেন Dean Radin নামক আরেক অপবিজ্ঞান প্রচারকের কাছে। ইমোতো আর ডিন র‍্যাডিন মিলে ডিন র‍্যাডিনেরই নিজের জার্নাল “Explore: The Journal of Science and Healing” এ ইমোতোর এই ক্রিস্টাল কেচ্ছার ওপর একটা পেপার পাবলিশ করেন। যেখানে পিয়ার রিভিউ কিংবা ডবল ব্লাইন্ড সিস্টেমের বালাই ছিলো না। এবং সে জার্নালের ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর হচ্ছে মাত্র ২.৩৫৮। গড়ে মোটামুটি ২ টার মতো সাইটেশন আসে। কিন্তু আমাদের দেশের অপবিজ্ঞান লেখকদের তো আর এতোসব ঘেঁটে দেখার সময় নেই। থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসলেই তো সমস্যা। বইয়ের সাইজ কমে যাবে। তাদের মূল কাজ হচ্ছে গুগল সার্চ করে তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মতামতের সাথে যায়, এমন ছাইপাঁশ লিখে বইয়ের পৃষ্ঠা ভরানো।


লেখাটায় একটুখানি চাঞ্চল্যতা আনতে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। অল্টারনেটিভ মেডিসিনের এই “ডাঃ” ইমোতোর মতে সিগারেট ততোটা ক্ষতিকর না। মানুষের শরীরের ক্ষতি করে আসলে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লিখা “স্মোকিং কিলস” টাইপ নেগেটিভ কথাগুলি। তার ভাষ্যে,

“The word itself has energy to kill people”….!


তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যেন সিগারেটের প্যাকেটে ভালো কিছু লিখে দেয়া হয় ক্ষতির পরিমাণ কমাতে। “কষ্টিপাথর” বইটিতে লেখক পানিপড়া বা ঝারফুঁক এর মতো ব্যাপারগুলিকে বৈজ্ঞানিক এবং বাস্তবতা হিসেবে দাবি করেছেন একই হাস্যকর ব্যখ্যার মাধ্যমে। যেহেতু, আমাদের শরীরের প্রায় ৭০% পানি, এবং যেহেতু মাসারু ইমোতো সাহেব বলেছেন ধর্মীয় শ্লোকে বরফ ক্রিস্টাল সুন্দর হেক্সাগনাল গঠন দেখায়, তাই “পানিপড়া” এবং “ঝারফুঁক” বৈজ্ঞানিক। সেই একই প্রবন্ধে লেখক দাবি করলেন, ‘পানির হেক্সাগনাল আকৃতিই সবচেয়ে নিখুঁত আকৃতি’। ভদ্রলোকের এ দাবি দেখে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত, তা অনেকখানি আঁচ করা যায়। আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে, লেখকের কেন মনে হলো মানবদেহের পানি বরফ ক্রিস্টাল হয়ে থাকে?


এই যে ক্রিস্টালের হেক্সাগনাল আকৃতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কেবল বরফেই পানির অণুগুলি এমন হেক্সাগনাল আকৃতিতে থাকতে পারে। পানি কঠিন অবস্থায় থাকলেই কেবল এর অণুগুলি একটা ল্যাটিস স্ট্রাকচার অবলম্বন করতে পারে৷ অন্যথায় অণুগুলি এলোমেলো অবস্থায় থাকে। তাই “হেক্সাগনাল পানি” নামে কোনোকিছু এই পৃথিবীতে থাকা সম্ভব না। আমাদের শরীরে H2O তরল অবস্থায় থাকায় বরফ ক্রিস্টালের ল্যাটিস স্ট্রাকচারের সাথে আমাদের ভালো মন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। খুব অল্প রসায়ন জানা থাকলেও এসব অপবিজ্ঞান দিয়ে আপনাকে কেউ বিভ্রান্ত করতে পারবে না। এসব অপবিজ্ঞানে ঝুলে একদিকে অনেক লেখকেরা যেমন রঙচঙে বই বেচেন, অন্যদিকে বাইরের বেশ কিছু কোম্পানি ভুয়া ইলেকট্রনিকস বিক্রি করে। বিজ্ঞান, বাস্তবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সাধারণ পানিকে “হেক্সাগনাল পানি” বানানোর ভুয়া মেশিন বিক্রি করে বড় অংকের টাকা আয় করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।


এ লেখাটা শেষ করবো জেরাল্ড পল্যাক এর “পানির চতুর্থ দশা” -র কেচ্ছা দিয়ে।“কষ্টিপাথর” বইটির পানিপড়ার সেই একই প্রবন্ধে দেখতে পেলাম তিনি জেরাল্ড পল্যাকের এই কাজকে উচ্ছাসের সাথে “যুগান্তকারী বিপ্লবী” বলে দাবি করেছেন। জেরাল্ড পানির চতুর্থ দশাকে বর্ণনা করেছেন অনেকটা এভাবে- কোনো পানিগ্রাহী পদার্থে (যেমন টেফলন) যখন পানি রাখা হয়, তখন পানির অণুগুলি ধনাত্মক আর ঋণাত্মক অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। তারপর ঋণাত্বক চার্জযুক্ত অংশটি পানিগ্রাহী পদার্থের দেয়ালের সাথে সারিবদ্ধভাবে মিশে থাকে। জেরাল্ডের মতে এই (ঋণাত্বক চার্জযুক্ত পানি) অংশটুকুই হচ্ছে পানির চতুর্থ দশা। যেটার একটা পোশাকী নাম তিনি দিয়েছেন, ‘Exclusion zone’, সংক্ষেপে EZ। জেরাল্ড পানির সে চতুর্থ দশার রাসায়নিক সংকেত দিলেন H3O2।


এবার একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার লক্ষ করুন তো, H2O কে আমরা পানি বলি। অর্থাৎ শুধুমাত্র এমন রাসায়নিক বন্ধন আর এমন রাসায়নিক গঠন নিয়েই কেবল কোনো একটা পদার্থ পানি হিসেবে পরিগণিত হবে। কিন্তু, জেরাল্ডের কল্পিত এই ফোর্থ ফেজ H3O2 এর দিকে তাকান। এমন রাসায়নিক গঠিন নিয়ে কি কোনো অণু গঠন করা সম্ভব, যেটাকে পানি বলা যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। এমন রাসায়নিক গঠন নিয়ে যেটা তৈরি হবে, সেটার নাম, “দ্রবীভূত হাইড্রোক্সাইড আয়ন”। অর্থাৎ পানির অণুর সাথে বাড়তি একটা হায়ড্রোক্সাইড আয়ন। যেটা আদৌ কোনো মলিকিউল বা অণু-ই না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হাইড্রোক্সাইড নিজেও পানি না। সে হচ্ছে পানির অনুবন্ধী ক্ষারক। কোনো অম্ল থেকে একটি প্রোটন অপসারণের ফলে যে ক্ষারক সৃষ্টি হয় তাকে সে অম্লের অনুবন্ধী ক্ষারক বলে। জেরাল্ড পল্যাকের এই হাস্যকর গবেষণা প্রকাশিত হয় Water নামক এক জার্নালে। যেটার ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর সেই ২০১২ সালে ছিলো ০.৯৭৩; এবং সেই জার্নালের গড়ে ১ টারও কম আর্টিকেল সাইটেশন পেতো। যেখানে সেসময় বিখ্যাত Cell জার্নালের ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর ছিলো ৩১.৯৫৭, অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৩২ টা সাইটেশন আসতো।


খুব সাধারণ স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান জানা থাকলেই এমন অপবিজ্ঞান আর ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বগুলো আপনাকে আর গেলানো সম্ভব হবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জেরাল্ড পল্যাক এর নামে উইকিপিডিয়াও কোনো পেইজ রাখে নি। আজকের দিনে জেরাল্ড পল্যাকের প্রস্তাবিত এই “পানির চতুর্থ দশা” গত শতকের ৫০ থেকে ৬০ এর দশকে ছড়িয়ে যাওয়া “Water fluoridation controversy” এর মতোই কুখ্যাত। এবং বিজ্ঞান কম জানা মানুষ সেসব আকাশ থেকে টুপ করে মানুষ পরার মতোই বিশ্বাস করে নিচ্ছে। বিশেষত, আমাদের বঙ্গদেশের এই চতুর লেখকশ্রেণি যখন দেখবেন তাদের চিন্তাভাবনার সাথে ‘বিদেশী নামধারী’ কারোর কথা প্রমাণ হিসেবে জুড়ে দিচ্ছে; তখন তারা বইয়ের কাটতি বাড়াতে পৃষ্ঠা ভর্তি করবেন এসব অপবিজ্ঞান দিয়েই। আর এসব অপবিজ্ঞান সম্পর্কে নিজেদের এবং আশেপাশের মানুষকে সতর্ক করতে নজর রাখতে হবে তিকতালিকে, সাথে থাকতে হবে আমাদের।


মূল লেখক: মাহাথির তুষার
সম্পাদনা ও কপিরাইট: তিকতালিক-Tiktaalik

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *